তপন বোস
শুক্রবার, ১৩ আগস্ট ২০১০
এ উপত্যকায় আজ আরো চারজন নিহত হলো। আজ রমজান মাসের প্রথম জুমাবার। হত্যাকাণ্ডের শুরু কুপওয়ারার কাছের ত্রেহগাম, সোপুরের কাছের বোম্মাই ও পাঠানে ঠিক ফজরের নামাজের পরপর।
সারা দিন শ্রীনগরের বিভিন্ন অংশে
যুবকশ্রেণীর বিক্ষোভকারী এর প্রতিবাদে সরব স্লোগান দেয়। কাশ্মীর পুলিশের
সহায়তায় সিআরপিএফ তথা সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স অব্যাহতভাবে
বিক্ষোভকারীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সকালবেলায় সেখানে কারফিউ না থাকলেও
দুপুর থেকে কারফিউ কার্যকর করা হয়।
১৩ আগস্টে আমি বিমানবন্দর থেকে গাড়ি চালিয়ে শ্রীনগর যাচ্ছিলাম। পথে আমার গাড়ি সাতজায়গায় থামানো হয়। সিআরপিএফ ও কাশ্মীর পুলিশের প্রহরী দল মোতায়েন ছিল সবখানে। আমার ভারতীয় পাসপোর্ট থাকায় এসব চেকপোস্ট পার হতে পেরেছিলাম। যদিও এক জায়গায় একজন কনস্টেবল আমাকে প্রশ্ন করলেন, যেখানে ভারতীয়রা আক্রান্ত তখন আমি কেনো শহরে বের হলাম? সত্যটা হচ্ছে, একজন অমরনাথ মন্দির যাত্রীর ওপরও আক্রমণ হয়নি। এমনটিও মনে হয়নি গত দুই মাসে একজন অকাশ্মীরিকেও লক্ষ্যে পরিণত করা। সিআরপিএফ জওয়ানদের অভিমত, তাদের ওপর পাথর ছোড়েছে কাশ্মীরিরা, আর এটি যথেষ্ট প্রমাণ যে, কাশ্মীরিরা ইচ্ছে করেই ভারতীয়দের ওপর হামলা করছে। আমি এ ধারণা চ্যালেঞ্জ করিনি যে, সিআরপিএফ এ উপত্যকায় ভারতের ‘প্রতিনিধিত্ব’
করেছে।
কোনো প্রহরী দলেই, সেটি সিআরপিএফ’রই হোক, কিংবা হোক কাশ্মীরি পুলিশের কোনোটিতেই কোনো ঊর্ধ্বতন অফিসার দেখতে পেলাম না। মনে হয়েছে, এরা অন্য কোথাও ব্যস্ত। দিনের শেষে আমি এ বিষয়টি আমার সাথে সাক্ষাৎ হওয়া আরো কয়জন সাংবাদিককে জানালাম। তারাও আমাকে বললেন, তারাও রাস্তায় কোনো অফিসার দেখতে পাননি। সাধারণত এসএইচও, সাব ইনস্পেক্টর, হেড কনস্টেবল ও হাবিলদারেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের ওপর বল প্রয়োগ ও কতটুকু মাত্রায় বল প্রয়োগ করা হবে, সে বিষয়টি।
দেশের আইন বলছে, রাষ্ট্র বেসামরিক লোকদের মোকাবেলার সময় ‘মিনিমাম’ বল প্রয়োগ করবে। আইনের নির্দেশ আছে, নিয়ন্ত্রণহীন জনতার ওপর ব্যাটন চার্জের আদেশ, কাঁদানে গ্যাসের ব্যবহার, লাইভ বুলেট ফায়ার করার আদেশ দিবে একজন ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের কর্মকর্তা। আইনে আরো নির্দেশ আছে, উপরোল্লিখিত যেকোনো পদক্ষেপ নেয়ার আগে যথাযথভাবে জনতাকে সতর্ক করে দিতে হবে।
স্পষ্টত কাশ্মীরে কর্তৃপক্ষ এসব আইনি প্রয়োজন মেটানো হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে। সিআরপিএফ ও কাশ্মীরি পুলিশ সেনাবাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে, বিশেষ করে বিশ বছর ধরে কাজ করছে একীভূত তথা ইউনিফাইড কম্যান্ডের অধীনে। সেনাবাহিনী শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ বল প্রয়োগ করার যে সুযোগ পায় ‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টের’ অধীনে, তারই অভ্যন্তরীকরণ করেছে এরা। এই আইনের আওতায় যেকোনো সাধারণ সৈনিকও সন্দেহভাজন কাউকে হত্যা করতে পারবে এবং এ জন্য তাকে কোনো শাস্তি পেতে হবে না। সিআরপিএফ ও কাশ্মীরি পুলিশ আগে গুলি করে, পরে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। সব মৃত সন্ত্রাসী ভালো সন্ত্রাসী, কারণ মৃতরা কথা বলে না। কিন্তু কাশ্মীরে মৃতরাও কথা বলেছিল সেদিন।
যেভাবে এর শুরু
বিক্ষোভের শুরু মে মাসে মাটি খুঁড়ে তিন যুবকের লাশ তোলার পর। এই তিন যুবক ছিলেন শাহজাদ আহমেদ খান, রিয়াজ আহমেদ লোন ও মোহাম্মদ শফি লোন। এরা উত্তর কাশ্মীরের কুপওয়ারা জেলার নাদিহাল গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। চার নম্বর রাজপুত রেজিমেন্টের কম্যান্ডিং অফিসার ৩০ এপ্রিল ও অন্যান্য রেজিমেন্ট অফিসার দাবি করেন, এরা পাকিস্তানি সন্ত্রাসী যারা লাইন অব কন্ট্রোল তথা নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করে ভারতে অনুপ্রবেশ করতে যাচ্ছিল। সেনাবাহিনীর দাবি, এসব বালক নিহত হয় এক এনকাউন্টারে। আর এই এনকাউন্টার সংঘটিত হয়েছিল শ্রীনগরের ১০০ কিলোমিটার উত্তরের মাচিলে। এ এনকাউন্টার হয় এসব সন্ত্রাসী ও রাজপুত রেজিমেন্টের মধ্যে। নাদিহাল গ্রাম থেকে নিখোঁজ হওয়া এই তিন যুবকের পরিবারের সদস্য তাদের লাশ শনাক্ত করে পুলিশের প্রকাশ করা ‘ডেড টেরোরিস্টের’ ছবি দেখে। ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে এদের লাশ কুপওয়ারায় মাটি খুঁড়ে বেরা করা হয়। শাহজাদ আহমেদ খান, রিয়াজ আহমেদ লোন ও মোহাম্মদ শফি লোনের লাশ কবর থেকে ‘উঠে’ ভারতীয় সেনাবাহিনীর মিথ্যাচারকেই প্রকাশ করল।
৫ জুনে সেনাবাহিনীর শ্রীনগরভিত্তিক নর্দার্ন কম্যান্ডের প্রধান সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ৪ নম্বর রাজপুত রেজিমেন্টের দুইজন সেনাকর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং কোর্ট অব ইনকোয়ারির আদেশ দেয়া হয়েছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, তদন্তপ্রক্রিয়া হবে স্বচ্ছ। কিন্তু কাশ্মীরিরা তাকে বিশ্বাস করেনি। এ ধরনের মিথ্যে এনকাউন্টারে সেনাবাহিনীর হাতে নিহত বেসামরিক কাশ্মীরিদের লাশ আবিষ্কৃত হয়েছে অতীতেও কুপওয়ারা, কুকারনাগ, পার্থিবাল ও আরো অনেক স্থানে। এর কমই বিচার পাওয়া গেছে। এসব খুনের সাথে জড়িত কোনো সেনাকর্মকর্তা কিংবা নিরাপত্তা বাহিনী কর্মকর্তাকে কোনো বেসামরিক আদালতের মুখোমুখি হতে হয়নি। কারণ আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টে এদের আদালতের আইনের ঊর্ধ্বে রাখা হয়েছে।
বিক্ষোভ কাশ্মীর উপত্যকার উত্তর থেকে দক্ষিণের জেলাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৩-৯৪ সালের পর থেকে এ উপত্যকার জনগণ, সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর দমন-পীড়িন, কর্ডন ও সার্চ, গ্রেফতার, নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, বাজার, বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন পুড়িয়ে দেয়া মোকাবেলা করতে না পেরে রাস্তায় বিক্ষোভ বাতিল করে দিয়েছিল। এবার আবার এই প্রথম মানুষ বাইরে বেরিয়ে এসেছে। এবার নিরাপত্তা বাহিনীর বুলেট উপেক্ষা করে কাশ্মীরিরা ব্যাপকভাবে রাজপথে নেমে এসেছে। এই বিক্ষোভ উপত্যকার প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। শিশু, তরুণ-তরুণী এমনকি বয়োবৃদ্ধরাও রাস্তায় বেরিয়ে ভারতকে উদ্দেশ করে স্লোগান দিচ্ছেন ‘কাশ্মীর ছাড়ো’। এবারের বিক্ষোভ অতীত থেকে ব্যতিক্রমী হয়ে মনে হচ্ছে, এরা এবার সৈনিক ও বুলেটের ভয়ে আর ভীত নয়। ষাটজনকে হত্যা করা হয়েছে।
শ্রীনগর জেলা আদালতের বাইরে আমার দেখা হয় এক অল্প বয়সী মহিলা আইনজীবীর সাথে। তিনি সকালেই এসেছেন কিছু জরুরি কাজ সারতে এবং তাকে সারাদিন এখানেই থাকতে হয়। কারণ কারফিউ জারি হয়ে গেছে। এখন তিনি চেষ্টা করছেন কিছু একটায় চড়ে বাড়ি যেতে। কারণ ইফতারের পর কারফিউ শিথিল করা হয়েছে। আমি তার কাছে জানতে চাই, তিনি কি এই বিক্ষোভ-আন্দোলন সমর্থন করেন? ‘অবশ্যই আমি সমর্থন করি’ তিনি জবাব দেন। ‘প্রত্যেক কাশ্মীরি এ সংগ্রামের এক-একটি অংশ। বিগত ২০ বছরে ৮০ হাজার কাশ্মীরিকে হত্যা করা হয়েছে। তাতেও আমাদের থামাতে পারেনি। স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমরা আরো মরার জন্য প্রস্তুত’ তিনি বললেন। তিনি উপহাস করেন ভারতীয় গণমাধ্যমের উপলব্ধিকে। কারণ ভারতীয় গণমাধ্যম মনে করে এটি হচ্ছে, ‘টেরোরিস্টদের’ পরিচালিত ‘অ্যাজিটেশনাল টেরোরিজম’। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনী সত্যিই কি বিশ্বাস করে, গোটা উপত্যকার সব জেলায় পাকিস্তানিদের এই সহায়তাপুষ্ট সন্ত্রাসীরা ছড়িয়ে পড়েছে এবং এরা কাশ্মীরের হাজার হাজার শিশু, তরুণ-তরুণীকে কারফিউ উপেক্ষা করে ঘরের বাইরে আনার ব্যাপারে প্ররোচিত করতে সক্ষম হয়েছে। সিকিউরিটি ফোর্সের সংঘর্ষ উপেক্ষা করে, পাথর ছোড়ার বিনিময়ে কাঁদানে গ্যাস মোকাবেলা করার জন্য; লাঠিচার্জ, গুলি ও মৃত্যুকে উপেক্ষা করে এরা রাস্তায় নেমে এসেছে।
এ প্রশ্নে জবাব
What do you want প্রশ্নটি করা। এ প্রশ্নটি কাকে করা হলো সেটা কোনো বিবেচ্য নয়।
‘আমরা চাই ভারত এটি স্বীকার করুক কাশ্মীর একটি বিতর্কিত কিংবা অমীসাংসিত ভূখণ্ড। আমরা চাই সিআরপিএফ ও অন্য সব কেন্দ্রীয় বাহিনী কাশ্মীর ছাড়–ক। আমরা চাই আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট সংশোধন করা হোক এবং আমরা চাই আমাদের সব বন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হোক।’
গত দুই মাসে বিক্ষোভের সময়ে, এমনকি ২ শতাংশ সরকারি কর্মকর্তাসহ সরকারি চাকুরে অফিসে যায়নি। শুধু স্টেট গভর্নমেন্টের পুলিশই দৃশ্যমান হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী আর্তনাদ করে বলেছেন, তিনি সিআরপিএফ’র ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। নয়াদিল্লি তার লাগাম টেনে ধরেছে। ২৮ জুন ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনানুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে তাদের (সিআরপিএফ’র) প্রশংসা করেছে কাশ্মীরে ভালো ভূমিকা পালনের জন্য জটিল এ পরিস্থিতিতেও। মুখ্যমন্ত্রী তার মন্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। নয়াদিল্লি আবারো দেখিয়ে দিলো, শ্রীনগরের ‘নির্বাচিত সরকার’ একটি পুতুল সরকার বৈ কিছু নয়।
আগস্ট ১৪, ২০১০
রমজানের তৃতীয় দিন। ইফতারের ঠিক আগে সিআরপিএফ গুলি করে দুই ব্যক্তিকে হত্যা করে। একজনকে হত্যা করা হয় দক্ষিণ কাশ্মীরের ইসলামাবাদে। অপরজনকে শ্রীনগরের এক প্রান্তের নারবালে। পুলিশ ও সৈন্যরা আরো চার জায়গায় বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ছোড়ে। এতে আহত হয় কমপক্ষে কয়েক ডজন।
দিনের শেষ দিকটায় হজরতবাল মাজারে ব্যাটন (লাঠি) চার্জে ও কাঁদানে গ্যাসে আহত হয় প্রায় ৩৩ জন। সেখানে নামাজ শেষে কিছু লোক ভারতবিরোধী স্লোগান দেয়। আজকের নিহতের সংখ্যাসহ ১১ জুন থেকে সিআরপিএফ ও পুলিশের হাতে নিহতের সংখ্যা পৌঁছেছে ৫৮তে।
আগস্ট ১৫
ভারতের ৬৩তম স্বাধীনতা দিবস। বিক্ষোভের ৬৪তম দিন। আর রমাজনের চতুর্থ দিন। কাশ্মীর উপত্যকার সবখানে কড়াভাবে কারফিউ কার্যকর করা হয়েছে। খুব সকালে নওহাটায় যখন একদল যুবক মিছিল বের করতে চেষ্টা করে, তখন পুলিশ তাদের পিছু হটিয়ে দেয়। সেখানে লাঠিচার্জ কিংবা গুলি করা হয়নি। কোনো প্রাণহানি ঘটেনি।
দিল্লির ঐতিহাসিক লালদুর্গের ঢিবি থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীরিদের প্রতি ‘সন্ত্রাসী প্রতিবাদের’ অবসান ঘটানোর আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসের বছরগুলোর এখানে সমাপ্তি টানা উচিত। এ ধরনের সন্ত্রাস কারো জন্য উপকার বয়ে আনবে না।’ কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে জোরালো অভিমত প্রকাশ করে ড. মনমোহন সিং আলোচনার আহ্বান জানান এবং বলেন, ‘আলোচনা হবে প্রতিটি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সাথে, যারা শপথ করে সন্ত্রাস পরিত্যাগ করবে।’
আজ স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করে অভিবাদন গ্রহণ করছিলেন শ্রীনগরের বকশি স্টেডিয়ামে এক সরকারি অনুষ্ঠানে। আবদুল আহাদ জাহান নামে এক পুলিশ কনস্টেবল তার প্রতি জুতা নিক্ষেপ করে। বাদামি এ জুতা মুখ্যমন্ত্রীর গায়ে লাগেনি। জুতা নিক্ষেপকারী কালো পতাকা নেড়ে স্বাধীনতার স্বপক্ষে স্লোগান উচ্চারণ করছিলেন। এ সময় নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে ধরে নিয়ে যায়।
এখান থেকে আমাদের গন্তব্য কোথায়?
আমার বিশ্বাস, এখনো সম্ভাবনা বিদ্যমান কাশ্মীরকে অতলগহ্বরের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনার, স্থিতিশীলতায় ফিরিয়ে আনার এবং একটি গণতান্ত্রিক সমাধানে আসার। কিন্তু এ জন্য প্রয়োজন অসীম সাহসের ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার। এই সাহস ও সদিচ্ছা নিয়ে কাশ্মীরের চরম বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতে হবে। বাস্তবতার স্বীকৃতি দিতে হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের অফিসে যোগদানে রাজ্যসরকারের ব্যর্থতা এবং বাজার, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়া এই আভাসই দেয়, রাজ্য সরকার কার্যত কাশ্মীরের ওপর যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।
এটি স্পষ্ট, বাবা-মাকে তাদের ছেলেমেয়েদের ঘরে রাখতে বলাটা শুধু অকার্যকরই হবে না, বরং এমনটি বলা এ উপত্যকার মানুষকে অপমান করার শামিল। যারা তাদের জীবন উৎসর্গ করছে ন্যায়ের জন্য, তাদেরকে মোকাবেলা করার জন্য সিআরপিএফ ও অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনী পাঠানো যতবারই এরা বাইরে বেরিয়ে আসবে, ততবার তাদের ক্ষোভ নিবারণ ও পাথর ছোড়া মোকাবেলার জন্য তা কোনো ফল বয়ে আনবে না। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য সিআরপিএফকে প্রশংসা করা বলদের সামনে লাল কম্বল দোলানোরই শামিল। প্রধানমন্ত্রীর স্বাধীনতা দিবসের প্রস্তাব ‘শপথ করে সন্ত্রাস পরিহারকারী সর্বজন ও দলের সাথে আলাপ’ তাৎক্ষণিকভাবে শ্রীনগরের রাজপথেই প্রত্যাখ্যাত হয়। যুবকরা ড. সিংয়ের এ সাড়াকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর সাড়ার সাথে তুলনা করছে, সেখানেও পাথর ছোড়া ফিলিস্তিনিদের জবাব এমনভাবে দিচ্ছে ইসরাইল।
এখন সময় এসেছে এ উপলব্ধির, নির্বাচন আয়োজনের তথাকথিত চর্চা এবং জম্মু কাশ্মীরে একটি ‘গণতান্ত্রিক সরকার’ বসানো কার্যত গণতন্ত্রের অন্তঃসারশূন্যতাকেই প্রকাশ করেছে। ফ্রান্স এর দখল করা আলজেরিয়ায় নির্বাচন দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রও একই কাজ করেছে দখল করা ভিয়েতনামেও এবং অতি সম্প্রতি ইরাকে ও আফগানিস্তানে। এসব নির্বাচন কি সেসব দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে পেরেছে?
এখন সময় এ উপলব্ধির যে, গণতন্ত্রে এ ধরনের চর্চা সৃষ্টি করেছে নয়াদিল্লির এক ধরনের আমলা-রাজনীতিক শ্রেণী, যা তাদের স্ফীত করে তুলেছে, কিছু বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়ার ব্যাপারে। রাজ্যের সাধারণ মানুষের জন্য প্রতিটি পরিকল্পনায়, প্রতিটি প্রকল্পে, প্রতিটি পরিকল্পে এদের হাত সবার ওপরে। এরা মাখনটা তুলে নিয়ে সরতোলা দুধটা বিতরণ করে তাদের অনুগত সমর্থকদের মাঝে। এভাবেই এরা সম্প্রসারণ করে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং গড়ে তোলে ব্যক্তিগত ভাড়াটে গুণ্ডাবাহিনী।
জম্মু কাশ্মীরের প্রতিটি রাজনৈতিক দল দুর্নীতিগ্রস্ত। এরা রাজ্যের ট্রেজারি উজাড় করছে নানাভাবে। উদাহরণ টেনে বলা যায়, রাজ্য সরকারের রোস্টারের তিন কোটি ৭০ হাজার কর্মচারীর মধ্যে প্রায় দুই কোটি বর্তমান ও সাবেক মন্ত্রী, এমএলএ ও এমপিদের এবং বর্তমান ও সাবেক আমলাদের ব্যক্তিগত কিংবা গৃহভৃত্য। জম্মু-কাশ্মীর ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত রাজ্য হিসেবে পরিচিত।
নয়াদিল্লি পরিত্যাগ করতে হবে জম্মু-কাশ্মীরের এই ধাঁধার ‘গণতন্ত্র’। এসব অনধিকার হস্তক্ষেপকারীদের সরাতে হবে। এসব হস্তক্ষেপকারী হচ্ছে সেইসব রাজনীতিবিদ,যারা বিগত ছয় দশক ধরে রাজনীতি চর্চা করেছেন ও সরাসরি কাশ্মীরের চার্জে ছিলেন। শুরু করুন এক নতুন অধ্যায়, সব ভুলের জন্য জনসাধারণের কাছে ক্ষমা চেয়ে। শুধু শক্তিধর মানুষই পারে তার ভুল স্বীকার করে মাফ চাইতে। দুর্বল ও ছোটলোকরা কখনোই তাদের ভুল স্বীকার করতে পারে না।
'abjure violence' তথা ‘সন্ত্রাস পরিহার করার শপথ’ নেয়ার মতো পূর্বশর্ত আরোপের প্রয়োজন নেই। বর্তমানে কাশ্মীরের চলমান আন্দোলন সন্ত্রাসী আন্দোলন নয়। বিক্ষোভকারীদের পেছনে কোনো মিলিটেন্ট বা সন্ত্রাসীর অস্তিত্ব নেই। পুলিশের হ্যান্ড আউটে কী দাবি করা হলো, তা কোনো বিবেচ্য নয়, বিক্ষোভকারীরা বন্দুক ব্যবহার করেছে এমন সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। পাথর ছুড়ছে এমন জনতার ওপর নির্বিচারে বুলেট ছোড়া এটাই প্রমাণ করে, আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর লোকরা সব ধরনের আনুপাতিক জ্ঞান হারিয়ে বসেছে।
যুবকদের সন্ত্রাস দমনের আহ্বান না জানিয়ে, এর বদলে নয়াদিল্লির উচিত একপক্ষীয়ভাবে আটক সব বন্দী মুক্ত করে দেয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার ‘ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন’-এর অনুরূপ একটি স্বচ্ছ জাস্টিস কমিশন গঠন করা। সেই সাথে কাশ্মীরি জনগণের প্রতি এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ জানানো। নয়াদিল্লিকে নিয়োগ করতে হবে কয়েকটি টাস্ক ফোর্স, যা সমাধান করবে সব রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার, যেসব সমস্যা সেখানকার মানুষকে বিুব্ধ করে তুলেছে। উপত্যকাজুড়ে কাজটি করতে হবে খোলাখুলি ও স্বচ্ছতার সাথে। টাস্ক ফোর্সকে শুধু সুপারিশের ক্ষমতা দিলেই হবে না। সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষমতাও দিতে হবে। যখন এসব টাস্ক ফোর্সের সূচনা হবে জনগণের সাথে সব সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে জনগণের সাথেই খোলাখুলি আলোচনার মাধ্যমে, তখন হয়তো আমরা সমাধানের উপায় বেরিয়ে আসতে দেখবো অন্ধকার থেকে, যে অন্ধকার আজ কাশ্মীরকে ঢেকে রেখেছে। কাশ্মীরে একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নয়াদিল্লিতে কে আছে এ কথা শোনার।
[তপন বোস ভারতের একজন সুখ্যাত লেখক। সেই সাথে একজন মানবাধিকার কর্মীও। ২০১০ সালের আগস্ট মাসের কাশ্মীরের উত্তপ্ত ক’দিনের একটা বাস্তব চিত্র ডায়েরি আকারে তিনি তুলে ধরেছেন এই লেখায়। সেই সাথে প্রশ্ন তুলেছেন এরপর ভারতের গন্তব্য কোথায়? লেখাটি প্রকাশ করে ‘এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন’। মূল ইংরেজি থেকে লেখাটি ভাষান্তর করেছেন মুনীর তৌসিফ]
শুক্রবার, ১৩ আগস্ট ২০১০
এ উপত্যকায় আজ আরো চারজন নিহত হলো। আজ রমজান মাসের প্রথম জুমাবার। হত্যাকাণ্ডের শুরু কুপওয়ারার কাছের ত্রেহগাম, সোপুরের কাছের বোম্মাই ও পাঠানে ঠিক ফজরের নামাজের পরপর।
১৩ আগস্টে আমি বিমানবন্দর থেকে গাড়ি চালিয়ে শ্রীনগর যাচ্ছিলাম। পথে আমার গাড়ি সাতজায়গায় থামানো হয়। সিআরপিএফ ও কাশ্মীর পুলিশের প্রহরী দল মোতায়েন ছিল সবখানে। আমার ভারতীয় পাসপোর্ট থাকায় এসব চেকপোস্ট পার হতে পেরেছিলাম। যদিও এক জায়গায় একজন কনস্টেবল আমাকে প্রশ্ন করলেন, যেখানে ভারতীয়রা আক্রান্ত তখন আমি কেনো শহরে বের হলাম? সত্যটা হচ্ছে, একজন অমরনাথ মন্দির যাত্রীর ওপরও আক্রমণ হয়নি। এমনটিও মনে হয়নি গত দুই মাসে একজন অকাশ্মীরিকেও লক্ষ্যে পরিণত করা। সিআরপিএফ জওয়ানদের অভিমত, তাদের ওপর পাথর ছোড়েছে কাশ্মীরিরা, আর এটি যথেষ্ট প্রমাণ যে, কাশ্মীরিরা ইচ্ছে করেই ভারতীয়দের ওপর হামলা করছে। আমি এ ধারণা চ্যালেঞ্জ করিনি যে, সিআরপিএফ এ উপত্যকায় ভারতের ‘প্রতিনিধিত্ব’
করেছে।
কোনো প্রহরী দলেই, সেটি সিআরপিএফ’রই হোক, কিংবা হোক কাশ্মীরি পুলিশের কোনোটিতেই কোনো ঊর্ধ্বতন অফিসার দেখতে পেলাম না। মনে হয়েছে, এরা অন্য কোথাও ব্যস্ত। দিনের শেষে আমি এ বিষয়টি আমার সাথে সাক্ষাৎ হওয়া আরো কয়জন সাংবাদিককে জানালাম। তারাও আমাকে বললেন, তারাও রাস্তায় কোনো অফিসার দেখতে পাননি। সাধারণত এসএইচও, সাব ইনস্পেক্টর, হেড কনস্টেবল ও হাবিলদারেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের ওপর বল প্রয়োগ ও কতটুকু মাত্রায় বল প্রয়োগ করা হবে, সে বিষয়টি।
দেশের আইন বলছে, রাষ্ট্র বেসামরিক লোকদের মোকাবেলার সময় ‘মিনিমাম’ বল প্রয়োগ করবে। আইনের নির্দেশ আছে, নিয়ন্ত্রণহীন জনতার ওপর ব্যাটন চার্জের আদেশ, কাঁদানে গ্যাসের ব্যবহার, লাইভ বুলেট ফায়ার করার আদেশ দিবে একজন ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের কর্মকর্তা। আইনে আরো নির্দেশ আছে, উপরোল্লিখিত যেকোনো পদক্ষেপ নেয়ার আগে যথাযথভাবে জনতাকে সতর্ক করে দিতে হবে।
স্পষ্টত কাশ্মীরে কর্তৃপক্ষ এসব আইনি প্রয়োজন মেটানো হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে। সিআরপিএফ ও কাশ্মীরি পুলিশ সেনাবাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে, বিশেষ করে বিশ বছর ধরে কাজ করছে একীভূত তথা ইউনিফাইড কম্যান্ডের অধীনে। সেনাবাহিনী শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ বল প্রয়োগ করার যে সুযোগ পায় ‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টের’ অধীনে, তারই অভ্যন্তরীকরণ করেছে এরা। এই আইনের আওতায় যেকোনো সাধারণ সৈনিকও সন্দেহভাজন কাউকে হত্যা করতে পারবে এবং এ জন্য তাকে কোনো শাস্তি পেতে হবে না। সিআরপিএফ ও কাশ্মীরি পুলিশ আগে গুলি করে, পরে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। সব মৃত সন্ত্রাসী ভালো সন্ত্রাসী, কারণ মৃতরা কথা বলে না। কিন্তু কাশ্মীরে মৃতরাও কথা বলেছিল সেদিন।
যেভাবে এর শুরু
বিক্ষোভের শুরু মে মাসে মাটি খুঁড়ে তিন যুবকের লাশ তোলার পর। এই তিন যুবক ছিলেন শাহজাদ আহমেদ খান, রিয়াজ আহমেদ লোন ও মোহাম্মদ শফি লোন। এরা উত্তর কাশ্মীরের কুপওয়ারা জেলার নাদিহাল গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। চার নম্বর রাজপুত রেজিমেন্টের কম্যান্ডিং অফিসার ৩০ এপ্রিল ও অন্যান্য রেজিমেন্ট অফিসার দাবি করেন, এরা পাকিস্তানি সন্ত্রাসী যারা লাইন অব কন্ট্রোল তথা নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করে ভারতে অনুপ্রবেশ করতে যাচ্ছিল। সেনাবাহিনীর দাবি, এসব বালক নিহত হয় এক এনকাউন্টারে। আর এই এনকাউন্টার সংঘটিত হয়েছিল শ্রীনগরের ১০০ কিলোমিটার উত্তরের মাচিলে। এ এনকাউন্টার হয় এসব সন্ত্রাসী ও রাজপুত রেজিমেন্টের মধ্যে। নাদিহাল গ্রাম থেকে নিখোঁজ হওয়া এই তিন যুবকের পরিবারের সদস্য তাদের লাশ শনাক্ত করে পুলিশের প্রকাশ করা ‘ডেড টেরোরিস্টের’ ছবি দেখে। ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে এদের লাশ কুপওয়ারায় মাটি খুঁড়ে বেরা করা হয়। শাহজাদ আহমেদ খান, রিয়াজ আহমেদ লোন ও মোহাম্মদ শফি লোনের লাশ কবর থেকে ‘উঠে’ ভারতীয় সেনাবাহিনীর মিথ্যাচারকেই প্রকাশ করল।
৫ জুনে সেনাবাহিনীর শ্রীনগরভিত্তিক নর্দার্ন কম্যান্ডের প্রধান সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ৪ নম্বর রাজপুত রেজিমেন্টের দুইজন সেনাকর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং কোর্ট অব ইনকোয়ারির আদেশ দেয়া হয়েছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, তদন্তপ্রক্রিয়া হবে স্বচ্ছ। কিন্তু কাশ্মীরিরা তাকে বিশ্বাস করেনি। এ ধরনের মিথ্যে এনকাউন্টারে সেনাবাহিনীর হাতে নিহত বেসামরিক কাশ্মীরিদের লাশ আবিষ্কৃত হয়েছে অতীতেও কুপওয়ারা, কুকারনাগ, পার্থিবাল ও আরো অনেক স্থানে। এর কমই বিচার পাওয়া গেছে। এসব খুনের সাথে জড়িত কোনো সেনাকর্মকর্তা কিংবা নিরাপত্তা বাহিনী কর্মকর্তাকে কোনো বেসামরিক আদালতের মুখোমুখি হতে হয়নি। কারণ আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টে এদের আদালতের আইনের ঊর্ধ্বে রাখা হয়েছে।
বিক্ষোভ কাশ্মীর উপত্যকার উত্তর থেকে দক্ষিণের জেলাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৩-৯৪ সালের পর থেকে এ উপত্যকার জনগণ, সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর দমন-পীড়িন, কর্ডন ও সার্চ, গ্রেফতার, নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, বাজার, বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন পুড়িয়ে দেয়া মোকাবেলা করতে না পেরে রাস্তায় বিক্ষোভ বাতিল করে দিয়েছিল। এবার আবার এই প্রথম মানুষ বাইরে বেরিয়ে এসেছে। এবার নিরাপত্তা বাহিনীর বুলেট উপেক্ষা করে কাশ্মীরিরা ব্যাপকভাবে রাজপথে নেমে এসেছে। এই বিক্ষোভ উপত্যকার প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। শিশু, তরুণ-তরুণী এমনকি বয়োবৃদ্ধরাও রাস্তায় বেরিয়ে ভারতকে উদ্দেশ করে স্লোগান দিচ্ছেন ‘কাশ্মীর ছাড়ো’। এবারের বিক্ষোভ অতীত থেকে ব্যতিক্রমী হয়ে মনে হচ্ছে, এরা এবার সৈনিক ও বুলেটের ভয়ে আর ভীত নয়। ষাটজনকে হত্যা করা হয়েছে।
শ্রীনগর জেলা আদালতের বাইরে আমার দেখা হয় এক অল্প বয়সী মহিলা আইনজীবীর সাথে। তিনি সকালেই এসেছেন কিছু জরুরি কাজ সারতে এবং তাকে সারাদিন এখানেই থাকতে হয়। কারণ কারফিউ জারি হয়ে গেছে। এখন তিনি চেষ্টা করছেন কিছু একটায় চড়ে বাড়ি যেতে। কারণ ইফতারের পর কারফিউ শিথিল করা হয়েছে। আমি তার কাছে জানতে চাই, তিনি কি এই বিক্ষোভ-আন্দোলন সমর্থন করেন? ‘অবশ্যই আমি সমর্থন করি’ তিনি জবাব দেন। ‘প্রত্যেক কাশ্মীরি এ সংগ্রামের এক-একটি অংশ। বিগত ২০ বছরে ৮০ হাজার কাশ্মীরিকে হত্যা করা হয়েছে। তাতেও আমাদের থামাতে পারেনি। স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমরা আরো মরার জন্য প্রস্তুত’ তিনি বললেন। তিনি উপহাস করেন ভারতীয় গণমাধ্যমের উপলব্ধিকে। কারণ ভারতীয় গণমাধ্যম মনে করে এটি হচ্ছে, ‘টেরোরিস্টদের’ পরিচালিত ‘অ্যাজিটেশনাল টেরোরিজম’। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনী সত্যিই কি বিশ্বাস করে, গোটা উপত্যকার সব জেলায় পাকিস্তানিদের এই সহায়তাপুষ্ট সন্ত্রাসীরা ছড়িয়ে পড়েছে এবং এরা কাশ্মীরের হাজার হাজার শিশু, তরুণ-তরুণীকে কারফিউ উপেক্ষা করে ঘরের বাইরে আনার ব্যাপারে প্ররোচিত করতে সক্ষম হয়েছে। সিকিউরিটি ফোর্সের সংঘর্ষ উপেক্ষা করে, পাথর ছোড়ার বিনিময়ে কাঁদানে গ্যাস মোকাবেলা করার জন্য; লাঠিচার্জ, গুলি ও মৃত্যুকে উপেক্ষা করে এরা রাস্তায় নেমে এসেছে।
এ প্রশ্নে জবাব
What do you want প্রশ্নটি করা। এ প্রশ্নটি কাকে করা হলো সেটা কোনো বিবেচ্য নয়।
‘আমরা চাই ভারত এটি স্বীকার করুক কাশ্মীর একটি বিতর্কিত কিংবা অমীসাংসিত ভূখণ্ড। আমরা চাই সিআরপিএফ ও অন্য সব কেন্দ্রীয় বাহিনী কাশ্মীর ছাড়–ক। আমরা চাই আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট সংশোধন করা হোক এবং আমরা চাই আমাদের সব বন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হোক।’
গত দুই মাসে বিক্ষোভের সময়ে, এমনকি ২ শতাংশ সরকারি কর্মকর্তাসহ সরকারি চাকুরে অফিসে যায়নি। শুধু স্টেট গভর্নমেন্টের পুলিশই দৃশ্যমান হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী আর্তনাদ করে বলেছেন, তিনি সিআরপিএফ’র ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। নয়াদিল্লি তার লাগাম টেনে ধরেছে। ২৮ জুন ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনানুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে তাদের (সিআরপিএফ’র) প্রশংসা করেছে কাশ্মীরে ভালো ভূমিকা পালনের জন্য জটিল এ পরিস্থিতিতেও। মুখ্যমন্ত্রী তার মন্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। নয়াদিল্লি আবারো দেখিয়ে দিলো, শ্রীনগরের ‘নির্বাচিত সরকার’ একটি পুতুল সরকার বৈ কিছু নয়।
আগস্ট ১৪, ২০১০
রমজানের তৃতীয় দিন। ইফতারের ঠিক আগে সিআরপিএফ গুলি করে দুই ব্যক্তিকে হত্যা করে। একজনকে হত্যা করা হয় দক্ষিণ কাশ্মীরের ইসলামাবাদে। অপরজনকে শ্রীনগরের এক প্রান্তের নারবালে। পুলিশ ও সৈন্যরা আরো চার জায়গায় বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ছোড়ে। এতে আহত হয় কমপক্ষে কয়েক ডজন।
দিনের শেষ দিকটায় হজরতবাল মাজারে ব্যাটন (লাঠি) চার্জে ও কাঁদানে গ্যাসে আহত হয় প্রায় ৩৩ জন। সেখানে নামাজ শেষে কিছু লোক ভারতবিরোধী স্লোগান দেয়। আজকের নিহতের সংখ্যাসহ ১১ জুন থেকে সিআরপিএফ ও পুলিশের হাতে নিহতের সংখ্যা পৌঁছেছে ৫৮তে।
আগস্ট ১৫
ভারতের ৬৩তম স্বাধীনতা দিবস। বিক্ষোভের ৬৪তম দিন। আর রমাজনের চতুর্থ দিন। কাশ্মীর উপত্যকার সবখানে কড়াভাবে কারফিউ কার্যকর করা হয়েছে। খুব সকালে নওহাটায় যখন একদল যুবক মিছিল বের করতে চেষ্টা করে, তখন পুলিশ তাদের পিছু হটিয়ে দেয়। সেখানে লাঠিচার্জ কিংবা গুলি করা হয়নি। কোনো প্রাণহানি ঘটেনি।
দিল্লির ঐতিহাসিক লালদুর্গের ঢিবি থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীরিদের প্রতি ‘সন্ত্রাসী প্রতিবাদের’ অবসান ঘটানোর আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসের বছরগুলোর এখানে সমাপ্তি টানা উচিত। এ ধরনের সন্ত্রাস কারো জন্য উপকার বয়ে আনবে না।’ কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে জোরালো অভিমত প্রকাশ করে ড. মনমোহন সিং আলোচনার আহ্বান জানান এবং বলেন, ‘আলোচনা হবে প্রতিটি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সাথে, যারা শপথ করে সন্ত্রাস পরিত্যাগ করবে।’
আজ স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করে অভিবাদন গ্রহণ করছিলেন শ্রীনগরের বকশি স্টেডিয়ামে এক সরকারি অনুষ্ঠানে। আবদুল আহাদ জাহান নামে এক পুলিশ কনস্টেবল তার প্রতি জুতা নিক্ষেপ করে। বাদামি এ জুতা মুখ্যমন্ত্রীর গায়ে লাগেনি। জুতা নিক্ষেপকারী কালো পতাকা নেড়ে স্বাধীনতার স্বপক্ষে স্লোগান উচ্চারণ করছিলেন। এ সময় নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে ধরে নিয়ে যায়।
এখান থেকে আমাদের গন্তব্য কোথায়?
আমার বিশ্বাস, এখনো সম্ভাবনা বিদ্যমান কাশ্মীরকে অতলগহ্বরের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনার, স্থিতিশীলতায় ফিরিয়ে আনার এবং একটি গণতান্ত্রিক সমাধানে আসার। কিন্তু এ জন্য প্রয়োজন অসীম সাহসের ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার। এই সাহস ও সদিচ্ছা নিয়ে কাশ্মীরের চরম বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতে হবে। বাস্তবতার স্বীকৃতি দিতে হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের অফিসে যোগদানে রাজ্যসরকারের ব্যর্থতা এবং বাজার, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়া এই আভাসই দেয়, রাজ্য সরকার কার্যত কাশ্মীরের ওপর যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।
এটি স্পষ্ট, বাবা-মাকে তাদের ছেলেমেয়েদের ঘরে রাখতে বলাটা শুধু অকার্যকরই হবে না, বরং এমনটি বলা এ উপত্যকার মানুষকে অপমান করার শামিল। যারা তাদের জীবন উৎসর্গ করছে ন্যায়ের জন্য, তাদেরকে মোকাবেলা করার জন্য সিআরপিএফ ও অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনী পাঠানো যতবারই এরা বাইরে বেরিয়ে আসবে, ততবার তাদের ক্ষোভ নিবারণ ও পাথর ছোড়া মোকাবেলার জন্য তা কোনো ফল বয়ে আনবে না। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য সিআরপিএফকে প্রশংসা করা বলদের সামনে লাল কম্বল দোলানোরই শামিল। প্রধানমন্ত্রীর স্বাধীনতা দিবসের প্রস্তাব ‘শপথ করে সন্ত্রাস পরিহারকারী সর্বজন ও দলের সাথে আলাপ’ তাৎক্ষণিকভাবে শ্রীনগরের রাজপথেই প্রত্যাখ্যাত হয়। যুবকরা ড. সিংয়ের এ সাড়াকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর সাড়ার সাথে তুলনা করছে, সেখানেও পাথর ছোড়া ফিলিস্তিনিদের জবাব এমনভাবে দিচ্ছে ইসরাইল।
এখন সময় এসেছে এ উপলব্ধির, নির্বাচন আয়োজনের তথাকথিত চর্চা এবং জম্মু কাশ্মীরে একটি ‘গণতান্ত্রিক সরকার’ বসানো কার্যত গণতন্ত্রের অন্তঃসারশূন্যতাকেই প্রকাশ করেছে। ফ্রান্স এর দখল করা আলজেরিয়ায় নির্বাচন দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রও একই কাজ করেছে দখল করা ভিয়েতনামেও এবং অতি সম্প্রতি ইরাকে ও আফগানিস্তানে। এসব নির্বাচন কি সেসব দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে পেরেছে?
এখন সময় এ উপলব্ধির যে, গণতন্ত্রে এ ধরনের চর্চা সৃষ্টি করেছে নয়াদিল্লির এক ধরনের আমলা-রাজনীতিক শ্রেণী, যা তাদের স্ফীত করে তুলেছে, কিছু বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়ার ব্যাপারে। রাজ্যের সাধারণ মানুষের জন্য প্রতিটি পরিকল্পনায়, প্রতিটি প্রকল্পে, প্রতিটি পরিকল্পে এদের হাত সবার ওপরে। এরা মাখনটা তুলে নিয়ে সরতোলা দুধটা বিতরণ করে তাদের অনুগত সমর্থকদের মাঝে। এভাবেই এরা সম্প্রসারণ করে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং গড়ে তোলে ব্যক্তিগত ভাড়াটে গুণ্ডাবাহিনী।
জম্মু কাশ্মীরের প্রতিটি রাজনৈতিক দল দুর্নীতিগ্রস্ত। এরা রাজ্যের ট্রেজারি উজাড় করছে নানাভাবে। উদাহরণ টেনে বলা যায়, রাজ্য সরকারের রোস্টারের তিন কোটি ৭০ হাজার কর্মচারীর মধ্যে প্রায় দুই কোটি বর্তমান ও সাবেক মন্ত্রী, এমএলএ ও এমপিদের এবং বর্তমান ও সাবেক আমলাদের ব্যক্তিগত কিংবা গৃহভৃত্য। জম্মু-কাশ্মীর ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত রাজ্য হিসেবে পরিচিত।
নয়াদিল্লি পরিত্যাগ করতে হবে জম্মু-কাশ্মীরের এই ধাঁধার ‘গণতন্ত্র’। এসব অনধিকার হস্তক্ষেপকারীদের সরাতে হবে। এসব হস্তক্ষেপকারী হচ্ছে সেইসব রাজনীতিবিদ,যারা বিগত ছয় দশক ধরে রাজনীতি চর্চা করেছেন ও সরাসরি কাশ্মীরের চার্জে ছিলেন। শুরু করুন এক নতুন অধ্যায়, সব ভুলের জন্য জনসাধারণের কাছে ক্ষমা চেয়ে। শুধু শক্তিধর মানুষই পারে তার ভুল স্বীকার করে মাফ চাইতে। দুর্বল ও ছোটলোকরা কখনোই তাদের ভুল স্বীকার করতে পারে না।
'abjure violence' তথা ‘সন্ত্রাস পরিহার করার শপথ’ নেয়ার মতো পূর্বশর্ত আরোপের প্রয়োজন নেই। বর্তমানে কাশ্মীরের চলমান আন্দোলন সন্ত্রাসী আন্দোলন নয়। বিক্ষোভকারীদের পেছনে কোনো মিলিটেন্ট বা সন্ত্রাসীর অস্তিত্ব নেই। পুলিশের হ্যান্ড আউটে কী দাবি করা হলো, তা কোনো বিবেচ্য নয়, বিক্ষোভকারীরা বন্দুক ব্যবহার করেছে এমন সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। পাথর ছুড়ছে এমন জনতার ওপর নির্বিচারে বুলেট ছোড়া এটাই প্রমাণ করে, আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর লোকরা সব ধরনের আনুপাতিক জ্ঞান হারিয়ে বসেছে।
যুবকদের সন্ত্রাস দমনের আহ্বান না জানিয়ে, এর বদলে নয়াদিল্লির উচিত একপক্ষীয়ভাবে আটক সব বন্দী মুক্ত করে দেয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার ‘ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন’-এর অনুরূপ একটি স্বচ্ছ জাস্টিস কমিশন গঠন করা। সেই সাথে কাশ্মীরি জনগণের প্রতি এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ জানানো। নয়াদিল্লিকে নিয়োগ করতে হবে কয়েকটি টাস্ক ফোর্স, যা সমাধান করবে সব রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার, যেসব সমস্যা সেখানকার মানুষকে বিুব্ধ করে তুলেছে। উপত্যকাজুড়ে কাজটি করতে হবে খোলাখুলি ও স্বচ্ছতার সাথে। টাস্ক ফোর্সকে শুধু সুপারিশের ক্ষমতা দিলেই হবে না। সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষমতাও দিতে হবে। যখন এসব টাস্ক ফোর্সের সূচনা হবে জনগণের সাথে সব সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে জনগণের সাথেই খোলাখুলি আলোচনার মাধ্যমে, তখন হয়তো আমরা সমাধানের উপায় বেরিয়ে আসতে দেখবো অন্ধকার থেকে, যে অন্ধকার আজ কাশ্মীরকে ঢেকে রেখেছে। কাশ্মীরে একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নয়াদিল্লিতে কে আছে এ কথা শোনার।
[তপন বোস ভারতের একজন সুখ্যাত লেখক। সেই সাথে একজন মানবাধিকার কর্মীও। ২০১০ সালের আগস্ট মাসের কাশ্মীরের উত্তপ্ত ক’দিনের একটা বাস্তব চিত্র ডায়েরি আকারে তিনি তুলে ধরেছেন এই লেখায়। সেই সাথে প্রশ্ন তুলেছেন এরপর ভারতের গন্তব্য কোথায়? লেখাটি প্রকাশ করে ‘এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন’। মূল ইংরেজি থেকে লেখাটি ভাষান্তর করেছেন মুনীর তৌসিফ]
No comments:
Post a Comment