অধ্যায়-১০
আহমদ মুসা জেরুসালেমে পৌছে প্রধানমন্ত্রীর প্রশাসনিক ভবনের সামনে গাড়ি থেকে নেমেই দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে দোতলার বারান্দায় উঠে গেল।
সামনেই প্রধানমন্ত্রী মাহমুদের অফিস কক্ষ। দরজা খোলা।
আহমদ মুসা দ্রুত প্রবেশ করল অফিস কক্ষে।
প্রধানমন্ত্রীর অফিস কক্ষের সোফায় বসে ছিল আব্দুল্লাহ জাবের, আব্দুল্লাহ আমিন, এহসান সাবরী, জাফর জামিল, যুবায়ের আওয়াস, তালাত বে সবাই। সবাই এরা ফিলিস্তিন বিপ্লবের এক একটি করে স্তম্ভ, সংগ্রামের মনি-মানিক্য।
সবারই উদ্বেগ-আশংকায় মুষড়ে পড়া চেহারা।
আহমদ মুসাকে দেখেই সবাই উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা সালাম দিয়েছিল।
আহমদ মুসা দ্রুত প্রবেশ করল অফিস কক্ষে।
প্রধানমন্ত্রীর অফিস কক্ষের সোফায় বসে ছিল আব্দুল্লাহ জাবের, আব্দুল্লাহ আমিন, এহসান সাবরী, জাফর জামিল, যুবায়ের আওয়াস, তালাত বে সবাই। সবাই এরা ফিলিস্তিন বিপ্লবের এক একটি করে স্তম্ভ, সংগ্রামের মনি-মানিক্য।
সবারই উদ্বেগ-আশংকায় মুষড়ে পড়া চেহারা।
আহমদ মুসাকে দেখেই সবাই উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা সালাম দিয়েছিল।
ওরা সালাম গ্রহণ করল।
প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ তার টেবিলে ছিল না।
মাহমুদ কোথায়? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
কারও কাছ থেকে উত্তর এল না। সবার মুষড়ে পড়া চেহারায় ফেনিয়ে উঠেছে যেন বাধ ভাঙা আবেগ। বিপদগ্রস্ত অসহায় কোন মানুষ হঠাৎ স্বজনকে কাছে পেয়ে যেমন বাকরুদ্ধ কান্নায় ভেঙে পড়তে পারে। এদের অবস্থা তাই। এদের দু’চোখ থেকে দর দর করে নামছে অশ্রু।
এ সময় পাশের রুম থেকে মাহমুদ এসে তার অফিস কক্ষে প্রবেশ করল। আহমদ মুসাকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। সে আরও শিশুর মত কেঁদে ফেলল আহমদ মুসাকে পেয়ে।
আহমদ মুসা পিঠে হাত বুলিয়ে সান্তনার স্বরে বলল, মাহমুদ তুমিও এভাবে ভেঙে পড়েছে। তুমি না প্রধানমন্ত্রী!
মুসা ভাই, এই প্রথম কাঁদলাম। আল্লাহর পরে আপনার কাছে ছাড়া আমার তো কাঁদার জায়গা নেই। এটুকু না কাঁদলে আমি মরে যাব। মুসা ভাই সিনবেথের টর্চার সেল থেকে একদিন আমি তাকে উদ্ধার করে এনেছিলাম। দ্বিতীয়বার সে সেই টর্চার সেলে বন্দী হয়েছে আরও অনেক বেশি অপরাধ নিয়ে। আমি যে ভাবতেও পারছি না মুসা ভাই। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল মাহমুদ।
আহমদ মুসা কোন কথা না বলে তাকে ধরে নিয়ে এসে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসাল। চোখ মুছে দিয়ে বলল, তুমি যা বলার বলেছ, এসব নিয়ে দ্বিতীয়বার কথা বলো না। ভুলে যেয়ো না আল্লাহ আছেন এবং তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাশালী, তোমার সিনবেথের ওপরও।
বলে মাহমুদের সামনে চেয়ারে এসে বসল।
মাহমুদ রুমাল দিয়ে মুখটা ভালো করে মুছল। আহমদ মুসার শেষ কথাগুলো তার চোখে-মুখে ঔজ্জল্যের এক তড়িৎ প্রবাহ নিয়ে এসেছে। বলল, এক্সকিউজ মি মুসা ভাই। আল্লাহ সবার ওপর ক্ষমতাশালী।
‘ধন্যবাদ মাহমুদ’ বলে তাকাল আহমদ মুসা সোফায় বসা আব্দুল্লাহ জাবের, এহসান সাবরীদের দিকে। বলল, তোমরাও সফল বিপ্লবের একজন করে সিপাহসালার। তোমরাও কি ভুলে গিয়েছিলে আল্লাহ আছেন তোমাদের অভিভাবক হিসেবে?
স্যরি আহমদ মুসা ভাই, অবস্থা আমাদের জ্ঞান শূন্য করে দিয়েছে। পুলিশ ও আমরা স্পটের প্রাথমিক তদন্ত সম্পূর্ণ করেছি। কোন ক্লুই পাওয়া যায়নি। অবস্থা আমাদের দিশেহারা করে দিয়েছে মুসা ভাই। বলল আব্দুল্লাহ জাবের।
আহমদ মুসা ঘুরে বসল মাহমুদের দিকে। বলল, তোমার পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ কি বলছে? কিডন্যাপাররা কতজন ছিল, কি তাদের চেহারা, কোন পথে কিভাবে এল, কিভাবে গেল, এসব ব্যাপারে বলেছে কিছু?
তাদের ধারণা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তারা এসেছে। কয়েক গ্রুপ বোমা ফেলেছে। একাধিক গ্রুপ কিডন্যাপের কাজ করেছে। যা বোঝা যাচ্ছে, তাতে তারা ভাড়া করা ট্যাক্সিতে এসেছে, কিন্তু যাওয়ার সময় এ্যাম্বুলেন্সে করে পালিয়েছে। এ্যাম্বুলেন্সও তাদের লোকরাই এনে রেখেছিল। বোমা- বিস্ফোরণের পর তাদের এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সরে পড়া সহজ হয়েছে। পুলিশ এ্যাম্বুলেন্সকে শহরের উত্তর দক্ষিণ প্রান্তে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। বলল মাহমুদ।
গুলি-গোলা শুধু ওরাই চালিয়েছে, না পুলিশও? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
কিডন্যাপের সময় ওরা গুলী চালিয়েছে। আমাদের পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকরাও গুলী চালিয়েছে, কিন্তু সেগুলো ফাঁকা গুলী ছিল, না পয়েন্টেড বলা মুষ্কিল। বলল মাহমুদ।
ওদের কেউ মারা গেছে? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
মৃতের মধ্যে পুলিশ আছে, স্বেচ্ছাসেবক আছে এবং সাধারণ লোক। বিশেষ পোশাকের সন্দেহজনক কাউকে পাওয়া যায়নি। মাহমুদ বলল।
কিডন্যাপাররা বিশেষ পোশাকে ছিল বলে কোন প্রমাণ পাওয়া গেছে? বলল আহমদ মুসা।
না এরকম কেউ বলেনি। মাহমুদ বলল।
তার মানে কিডন্যাপাররা সাধারণ মানুষের পরিচিত পোশাকেই ছিল। আহমদ মুসা অনেকটা স্বগতোক্তি করল।
পরক্ষণেই আবার বলল, আমি স্পট দেখতে চাই, লাশগুলো কোথায়? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
স্পটটা ‘এ্যাজ ইট ইজ’ আছে। লাশগুলোও সেভাবেই আছে। আপনার দেখার জন্যেই এভাবে রাখা হয়েছে। বলল মাহমুদ।
আহমদ মুসা আব্দুল্লাহ জাবেরদের দিকে চেয়ে বলল, চল তাহলে যাই।
বলেই মাহমুদের দিকে ফিরে বলল, পুলিশরা তো ওখানে আছে, না?
আছে। আমিও আপনার সাথে যাব আহমদ মুসা ভাই। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধের সুর।
‘চল তোমরা নাকি আবার প্রটোকল লাগবে দেরি হবে না তো? বলল আহমদ মুসা।
ঘটনার পর প্রটোকল অনেকের জন্যেই হয়েছে, আপনার জন্যেও। ইচ্ছা করলেই আর আপনি যখন-তখন যেখানে সেখানে যেতে পারবেন না। তবে চলুন, এখন আমার এক প্রটোকলেই সবার হয়ে যাবে।
বায়তুল আকসা মসজিদের চত্বরে পৌছল সবাই।
বিভৎস দৃশ্য।
চারটি এলাকাকে কেন্দ্র করে বোমা ফাটানো হয়েছে। এমিলিয়া ও খতিবকে যে দিক দিয়ে গাড়িতে নিয়ে আসা হচ্ছিল তার দু’পাশে এবং পেছনের মূল ভেনুতে গাড়ি ও এ্যাম্বুলেন্স ছিল সেখানে।
মোট পঞ্চাশটির মত লাশ পড়ে আছে। আহতরা পুলিশ পাহারায় হাসপাতালে।
গোটা স্পটের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ঠিক বলেছে তোমার পুলিশ, ওরা অনেকগুলো গ্রুপে বিভক্ত ছিল। যারা বোমা ছুঁড়েছে, গুলী-গোলা চালিয়েছে তারা কিন্তু কিডন্যাপ করেনি। বোমা ছুঁড়ে মানুষকে প্যানিকি সরিয়ে দিয়েছে। তারপর যারা ম্যাডাম এমিলিয়া ও খতিব মহোদয়ের নিরাপত্তা দিচ্ছিল, তাদের উদ্দেশ্যে গুলী ছুঁড়ে হত্যা করে কিডন্যাপ নির্বিঘ্ন করা হয়েছে।
গুলীতে নিহত পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকদের লাশ যেখানে পড়েছিল, সেখানে গেল আহমদ মুসা। নিহত তিনজন পুলিশ ও চারজন সাইমুম স্বেচ্ছাসেবকের লাশ সেখানে ছিল। আহমদ মুসা বলল, বোমা ফাটার পর এরাই সম্ভবত ম্যাডাম ও খতিবকে আগলে রেখে গাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এদেরকে হত্যা করেই তাদের কিডন্যাপ করা হয়েছে।
কিন্তু চারদিকে ঘিরে রাখা এদেরকে গুলী করতে গিয়ে ওরা ম্যাডামদেরও ক্ষতি করেনি তো! বলল এহসান সাবরী।
না এহসান, ওরা ব্রাশ ফায়ার করেনি, এলোপাথারিও গুলী ছোঁড়েনি। রিভলবার দিয়ে ওরা পয়েন্টেড গুরী করেছে। দেখ না সবারই বুক কিংবা মাথা গুলীবিদ্ধ হয়েছে। ওরা ছিল একদমই ঠান্ডা মাথার প্রফেশনাল।
বলতে বলতে আহমদ মুসা হাঁটছিল গাড়ি যেখানে ছিল সেদিকে। পথে আহমদ মুসা দুই জায়গায় দলা পাকানো তুলা কুড়িয়ে পেয়ে থমকে দাঁড়াল। তুলাগুলো নাকের কাছে নিল। যা সন্দেহ করেছিল তাই। তুলাগুলোতে ক্লোরোফর্মের গন্ধ। আহমদ মুসা দুই দলা তুলা মাহমুদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ওদেরকে সংজ্ঞাহীন করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খুব চালাক ওরা। সংজ্ঞাহীন দু’জনকে ওরা যখন ধরাধরি করে এ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন কেউ দেখলেও তাদের সন্দেহ হয়নি। ভেবেছে বোমায় আহতদের এ্যাম্বুলেন্সে নেয়া হচ্ছে। আর কিডন্যাপকারী যারা ওদের ধরাধরি করে নিয়ে গেছে তারা সাধারণ ফিলিস্তিনিদের পোশাকে ছিল অথবা পুলিশের পোশাকেও থাকতে পারে। যাই হোক ওদের পরিকল্পনা নিখুঁত ছিল।
আহমদ মুসা ঘুরে ঘুরে সব লাশই দেখল।
মঞ্চের কিছু দূর সামনে যেখানে অনেকগুলো লাশ পড়ে আছে, তাদের থেকে কিছুটা দূরে পড়ে থাকা একটা লাশ দেখছিল আহমদ মুসা। মাথায় গুলীবিদ্ধ হয়ে সে মারা গেছে। মুখের চেহারাটা প্রায় রক্তে ঢেকে গেছে। গায়ে আরবী আলখেল্লা। চিৎ হয়ে পড়ে আছে। আলখেল্লার বোতামগুলো খোলা। খোলা জায়গা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভেতরের কলারবিহীন টি-সার্টের একটা অংশ। টি-সার্টের বুকের ওপরের সেই অংশে একটা মনোগ্রাম ষ্টিকারের ওপর তার চোখ আটকে গেল। ঝুঁকে পড়ল আহমদ মুসা। একটা ছবির ওপর রোমান হরফে ক্যালিওগ্রাফি ঢংয়ে সাইপ্রাস লেখা। আর প্রথম দৃষ্টিতে মুখ তোলা ক্যাংগারুর মত যাকে ছবি মনে হয়েছিল ওটা ছবি নয়, সাইপ্রাসের মানচিত্র। বসে পড়ল আহমদ মুসা। তার চোখে বিস্ময়, সাইপ্রাসের টি-সার্ট ফিলিস্তিনে! কোন সময়ই তো দেখা যায়নি। কিন্তু বসার পর সাইপ্রাসের নীল মানচিত্রের নিচটা ঘেঁষে ছোট হরফের লেখা চার শব্দের একটা লাইন চোখে পড়ল আহমদ মুসার। হিব্রু হরফ লেখা দেখে ভূত দেখার মত চমকে ওঠল আহমদ মুসা। হিব্রু হরফের লেখাটা হলো, ‘নিউ তোয়া ইন্টারপ্রাইজ, তোয়া।’ ‘তোয়া দ্বীপ’টা আহমদ মুসার চোখের সামনে ভেসে উঠল। তোয়া দ্বীপের বসতির প্রায় গোটাটাই ইহুদি। আর গোয়েন্দা রিপোর্ট হলো, এই তোয়াতেই গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ইসরাইল সরকারের অবশিষ্ট অংশ। তার মানে এই অভিযানের গোড়া তোয়ায়। তাহলে এমিলিয়াদেরকে ‘তোয়া’তেই নেয়া হয়েছে! এসব চিন্তায় বুঁদ হয়ে গিয়েছিল আহমদ মুসা। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল মাহমুদ ও আব্দুল্লাহ জাবেররা। তারা নিশ্চিত আহমদ মুসা টি-সার্টটায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু পেয়েছে।
মুসা ভাই, গুরুত্বপূর্ণ কিছু? একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করল মাহমুদ।
শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, মহাগুরুত্বপূর্ণ। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো আহমদ মুসা।
চারদিকে একবার তাকাল। জাবের, মাহমুদরা ছাড়া আশেপাশে কেউ নেই। পুলিশরা স্পটের চারদিকে ঘিরে দাঁড়ানো। মাহমুদের নিরাপত্তা প্রহরীরাও কিছু দূরে দাঁড়িয়ে।
সবার দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা নিচু কণ্ঠে বলল, এই যুবক ইহুদি। সে বন্দুকবাজদের একজন। দেখ তার আশেপাশে রিভলবার পাওয়ার কথা। বলে আহমদ মুসা চারদিকে তাকাল। বলল আব্দুল্লাহ জাবেরের দিকে তাকিয়ে, তোমরা লাশটাকে এখান থেকে সরাও দেখি।
লাশটা কয়েক হাত সরিয়ে নিল।
লাশের তলা থেকে বেরিয়ে পড়ল তার রিভলবার।
কিছু বলতে যাচ্ছিল এহসান সাবরী। আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলল, আমার কথা শেষ হয়নি এহসান।
‘স্যরি’ বলে চুপ করল এহসান সাবরী।
বন্দুকবাজ যারা ম্যাডাম এমিলিয়া ও খতিব মহোদয়কে নিরাপত্তা দানকারী আমাদের পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকদের হত্যা করেছে, এ যুবক তাদের একজন। তবে এর রিভলবার বের করাটা একটু আগেই হয়ে গিয়েছিল এবং পুলিশ বা স্বেচ্ছাসেবকরা তাকে দেখতে পায়। ফলে পুলিশ বা স্বেচ্ছাসেবকদের গুলীতে সে নিহত হয। সে নিহত হওয়ার সময় অন্যেরা বোধ হয় একটু সময় নিয়ে একযোগে ব্যস্ত ছিল। একটু থামল আহমদ মুসা।
থেমেই আবার বলে উঠল, আমার মনে হয়, আমাদের যা জানার তা জেনে গেছি। এই যুবক ‘তোয়া দ্বীপ’ থেকে এসেছে। আর তোমরা জান ‘তোয়া দ্বীপ’ এখন কি। আমি নিশ্চিত ম্যাডাম এমিলিয়া ও খতিব মহোদয়কে কিডন্যাপ করে তোয়ায় নেয়া হয়েছে।
মাহমুদসহ সবার চোখে-মুখে আকস্মিকতার এক বিস্ময়।
যুবকটি কি তোয়া দ্বীপের? বলল মাহমুদ। তার কণ্ঠে বিস্ময় ও উদ্বেগ।
যুবকটির টি-সার্টটি সাইপ্রাসে তৈরি। সাইপ্রাস থেকে ‘তোয়া’ দ্বীপের একটা প্রতিষ্ঠান টি-সার্ট ইমপোর্ট করেছে। প্রতিষ্ঠানটির সিল আছে টি-সার্টটির মনোগ্রামের নিচে। আর টি-সার্টটি একেবারে নতুন। বলল আহমদ মুসা।
মাহমুদ, জাবেররা এগিয়ে গিয়ে যুবকটির টি-সার্টের মনোগ্রাম দেখল।
উঠে দাঁড়াল ওরা। বলল মাহমুদ, আহমদ মুসা ভাই ঠিক বলেছেন, যুবকটি ‘তোয়া’ থেকে এসেছে সেটা নিশ্চিতই বলা যায়। কিন্তু একটা প্রমাণ থেকেই কি আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারি?
এস আরও বিকল্প তালাশ করি। যদি না পাওয়া যায়, তাহলে যা পাওয়া গেছে তাকেই টার্গেট করতে হবে। আহমদ মুসা বলল।
মাহমুদ কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার ওয়ারলেসটি ‘বিপ’ ‘বিপ’ সংকেত দিয়ে ওঠল।
সে পকেট থেকে ওয়াললেসটি তুলে নিল। সালাম দিয়ে ‘ইয়েস মাহমুদ’ বলে কথা শুনতে লাগল ওপারের।
মাঝে মধ্যে দু’একটা প্রশ্ন ছাড়া মাহমুদ শুনেই চলল। মুখ তার অনেকখানি সহজ হয়ে এসেছে।
ওপারের কথা শুনতে শুনতেই মাহমুদ তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
ওপারের কথা শেষ হতেই মাহমুদ আহমদ মুসার উদ্দেশ্যে দ্রুতকণ্ঠে বলল, মুসা ভাই, কথা বললাম আমাদের গোয়েন্দা প্রধানের সাথে। উনি সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য দিয়েছে, যা আপনার তত্বকেই সমর্থন করছে। এমিলিয়াদের ওরা মনে হচ্ছে ‘তোয়া’তেই নিয়েছে।
কি তথ্য দিয়েছেন তিনি। জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য থেকে তারা জেনেছেন, জেরুসালেমের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে যেখানে এ্যাম্বুলেন্স পাওয়া গেছে, সেখানকার একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, এ্যাম্বুলেন্স থেকে বেরিয়ে কয়েকজন লোক দু’জন মানুষকে ধরাধরি করে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো এক বড় প্রাদো জীপে তুলেছে। তারপর দ্রুত উত্তর দিকে চলে গেছে। কিডন্যাপ ঘটনার এক ঘণ্টার মধ্যে প্রাদো জীপটাকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে সামারিয়া পর্যন্ত পৌছে। যেহেতু জীপটা সামারিয়াতে পাওয়া গেছে, তাই ধারণা করা হচ্ছে উত্তর দিকেই তারা গেছে। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ লেবানন গোয়েন্দা বিভাগকে অনুরোধ করেছিল তাৎক্ষণিকভাবে দেখার জন্যে যে, দক্ষিণ লেবাননে ফিলিস্তিনের কোন গাড়ি বা এ্যাম্বুলেন্স অথবা সন্দেহভাজন কোন গাড়ি বা এ্যাম্বুলেন্স তারা দেখতে পায় কিনা। সেখান থেকে দু’টি খবর পাওয়া গেছে। আমাদের সর্ব উত্তর-পূর্বের শহর ক্বিরাত শামোনা থেকে ১০ মাইল উত্তরে আমাদের বর্ডার ও লেবাননের লিতানি নদীর কাছাকাছি রাস্তার পাশে আমাদের একটি মিলিটারি ট্রাক পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় খবর হলো, লেবাননের টায়ার বন্দরের পাশে একটা ট্রলার জেটির বাইরে একটা এ্যাম্বুলেন্স পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এদিকে ঘটনার দুই ঘণ্টা পরের একটা তথ্য পাওয়া গেছে আমাদের সর্ব উত্তর-পূর্বের বাইরে ঐ ক্বিরাত শামোনা থেকে। পুলিশ জানিয়েছে, একটা মিলিটারি ট্রাককে তারা দ্রুত গতিতে উত্তরে সীমান্তের দিকে যেতে দেখেছে। এসব তথ্য থেকে আমাদের গোয়েন্দা বিভাগেরও ধারণা কিডন্যাপাররা এই রুটে এবং এই গাড়িগুলেই ব্যবহার করেছে এবং সাগর পথেই কোথাও তারা গেছে। থামল মাহমুদ।
আহমদ মুসা গম্ভীর। বলল, তোমাদের গোয়েন্দা বিভাগকে ধন্যবাদ কিডন্যাপারদের তথ্য যোগাড়ের ক্ষেত্রে যা সাধ্যে কুলায় তার সবটুকুই তারা করেছে। আমরা এখন নিশ্চিত ধরে নিতে পারি, তারা ট্রলার নিয়ে লেবাননের কোনো শহরে অবশ্যই যায়নি, তুরষ্কে প্রবেশেরও প্রশ্ন ওঠে না, তারা অবশ্যই হয় সাইপ্রাস, না হয় সোজা ‘তোয়া’ দ্বীপে চলে গেছে। হতে পারে গভীর সাগরে কোন জাহাজ তাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। ট্রলার থেকে তারা সে জাহাজে উঠেছে।
একটু থামল আহমদ মুসা। ভাবল একটু। তারপর বলল, তাদের এই কিডন্যাপ অভিযান ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং অনেক প্রস্তুতির ফল। তবে তাদের দুর্ভাগ্য তারা আসল লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।
মাহমুদ এবং সবার চোখে বিস্ময়। মাহমুদেরই প্রশ্ন, একথা বলছেন কেন মুসা ভাই? এমিলিয়া এবং মহামান্য খতিব ও আমাদের নেতা শেখ আব্দুল্লাহকে তারা হাতে পেয়েছে।
মাহমুদ, মহামান্য খতিবকে তারা বিকল্প হিসেবে নিয়ে গেছে। আসল টার্গেট ওদের ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী ও তার স্ত্রীকে একই সাথে কিডন্যাপ করা। মাহমুদ তুমি তেলআবিব চলে যাওয়ায় বেঁচে গেছ। তোমাকে না পেয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে তারা বায়তুল আকসার খতিবকে নিয়ে গেছে। অবশ্য এ শিকারও তাদের জন্যে খুব বড়, এ কথা নিশ্চয় তারা এখন ভাবছে। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই জাবের, এহসান সাবরীরা সমস্বরে বলল, ঠিক বলেছেন মুসা ভাই।
তারপর আব্দুল্লাহ জাবের বলে উঠল, নিশ্চিতভাবে এটাই তাদের ষড়যন্ত্র ছিল। তাদের অসম্ভব আয়োজন থেকেও এটা বুঝা যায়। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী কিডন্যাপড! রাষ্ট্রের মর্যাদা কোথায় গিয়ে দাঁড়াত! প্রমাণ হতো, দেশে আইন-শৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রীকে কিডন্যাপ করতে পারলে তাদের বোধ হয় আরো কোন পরিকল্পনা ছিল।
হ্যাঁ, আব্দুল্লাহ জাবের, তারা দেশে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টির সুযোগ নিত। এ প্রস্তুতিও হয়তো তাদের ছিল।
আহমদ মুসা একটু থামল। থেমেই আবার বলল, বিপ্লব করা যত কঠিন, বিপ্লব রক্ষা করা তার চেয়েও কঠিন। শত্রুর এই আঘাত তোমাদের এলার্ট করে দিয়ে গেল মাহমুদ।
মাহমুদের চোখে-মুখে উদ্বেগ। বলল, সব কথাই ঠিক। শত্রুরা বসে নেই, কিন্তু আমরা সাফল্যের আবেশে বসে গিয়েছিলাম। আল্লাহ তারই শাস্তি দিয়েছেন হয়তো! আল্লাহ আমাদের মাফ করুন।
একটু থেমে আবার শুরু করল, বুঝতে পারছি, আমাদের অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা এবং বাইরের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে আরও সাবধান, আরও সক্রিয় হতে হবে। অন্যদিকে কিডন্যাপারদের কবল থেকে ওঁদের মুক্ত করার জন্যে আশু পদক্ষেপ প্রয়োজন। বলুন মুসা ভাই এখন আমাদের কি কি করণীয়?
বলেই অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল মাহমুদ।
মাহমুদ তোমাকে অস্থির হলে চলবে না। শান্ত হতে হবে তোমাকে। সব ঠিক আছে, সবই ঠিক হয়ে যাবে। তুমি জান, তোমার সহকর্মীরা অভ্যন্তরীন আইন-শৃঙ্খলার ব্যাপারে কি করতে হবে। বৈদেশিকভাবে তেমন ভয়ের কোন ক্ষেত্র নেই তুমি সেটা জান। আর কিডন্যাপারদের ডিল করার ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও, তুমি প্রধানমন্ত্রী নাহলে মাহমুদ, এ দায়িত্ব তোমাকেই দিতাম।
হঠাৎ সজল হয়ে ওঠা মাহমুদের দু’চোখ জড়িয়ে ধরল এসে আহমদ মুসাকে। দরদর করে তার দু’চোখে নেমে এল অশ্রু। এ অশ্রু আহমদ মুসার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতার, না ব্যর্থতা, বেদনায় ভেঙে পড়ার? দু’য়েরই হতে পারে।
আহমদ মুসা মাহমুদের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, বলেছি তো সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। দেখবে, আল্লাহর ইচ্ছায় তোমার এমিলিয়া এবং আমাদের বোন এমিলিয়া ও আমাদের খতিবকে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় নিয়ে আমি শীঘ্রই ফিরে আসছি। আমার জন্যে গাড়ির ব্যবস্থা করো বৈরুত যাওয়ার।
মাহমুদ আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বলল, এখনই যাবেন?
হ্যাঁ মাহমুদ। বলল আহমদ মুসা।
ভাইয়া আপনি বৈরুত যাবেন কেন? তোয়াই যদি টার্গেট হয়, তাহলে সরাসরি তো যেতে পারেন সমুদ্র পথে। আর মনে হচ্ছে, আপনি একা যাবেন। কিন্তু আমরা কেউ আপনার সঙ্গি হতে চাই। বলল আব্দুল্লাহ যাবের।
‘তোয়া’র চারদিকের সমুদ্রেই ওরা চোখ রাখবে। বিশেষ করে এদিক থেকে যাওয়া সব জাহাজ-জলযানকেই তারা সন্দেহ করবে। কিন্তু তোয়ায় পৌছতে হবে আমাদের সবার অলক্ষ্যে। আর এ ধরনের অভিযান দল বেঁধে হয় না, সুতরাং কাউকেই আমি সাথে নিচ্ছি না। আহমদ মুসা বলল।
‘বৈরুত যাওয়ার জন্যে আমি হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এতে তাড়াতাড়িও যাওয়া যাবে।’ বলল মাহমুদ।
মানে আমাকে ভিআইপি সাজিয়ে প্রচার করে দিতে চাও যে আমি বৈরুত গেছি! তা হবে না। আমি গাড়িতে যাব। নীরবে উঠব গিয়ে বৈরুতে। তোমাদের দূতাবাসেও যাব না। শুধু তুমি তোমাদের বৈরুত দূতাবাসে সাইমুমের যে ছেলেটা, আবু আমর, গোয়েন্দাকর্মী হিসেবে আছে, তাকে বলবে রাতে যেন সে বৈরুতের ‘সি ভিউ’ হোটেলে গিয়ে রেজিষ্ট্রার দেখে ‘হাবিব গনজালেস’ এর কক্ষে সে যায়। আমার এই মিশনে ‘হাবিব গনজালেস’ নামের পাসপোর্ট ব্যবহার করব। চল, তোমার অফিসে গিয়ে আমি ফ্রেস হবো। ইতোমধ্যে আমার জন্যে একটা ভিন্নগাড়ি ঠিক-ঠাক করো। অবশিষ্ট কথা পরে বলব, চল।
বলে আহমদ মুসা চলতে শুরু করল গাড়ির দিকে।
সবাই তার পেছনে পেছনে চলল।
সাইপ্রাসের দক্ষিণে ভূমধ্যসাগরের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসার ফিশিং ট্রলার বোটটি।
আহমদ মুসা যাত্রা করেছে দক্ষিণ সাইপ্রাসের পাফোস বন্দর থেকে। বন্দরটি মূলত ফিশিং বন্দর। আহমদ মুসা আগের দিন সাইপ্রাসে এসে থেমেছিল লিমাসোল বন্দরে একজন ট্যুরিষ্টের পরিচয়ে। বৈরুত থেকে সে সাইপ্রাসের ভিসা নিয়েছিল আবু আমরকে দিয়ে দালালের মাধ্যমে। পাসপোর্টে তার হবি লেখা আছে ফিশিং ও ফরেষ্ট ট্যুরে। আহমদ মুসা লিমসোল থেকে কিছু খোঁজ-খবর নিয়ে গতকালই সড়ক পথে এসেছিল দক্ষিণ সাইপ্রাসের সর্বদক্ষিণ বন্দর শহর পাফোসে। এখানে এসে আরও খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছিল, তোয়া উপকূল মাছ শিকারের জন্যে বিখ্যাত। সাইপ্রাস থেকেও জেলেরা মাছ শিকারে মাঝে মাঝে সেখানে যায়। অনুমতি নিয়ে ও রয়্যালটি দিয়ে সেখানে মাছ শিকার করা যায়। তবে কয়েকদিন হলো সেখানে মাছ শিকার ভীষণ কড়াকড়ির মধ্যে পড়েছে। সবাইকে মাছ শিকারের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। কথা বলে খুশি হলে তবেই এই অনুমতি মেলে। দ্বীপে ট্যুরিষ্টদের যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। আইনসংগত ও অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যবসায় ও চাকরির প্রয়োজন ছাড়া সাইপ্রাসবাসিরাও সেখানে যেতে পারে না।
আহমদ মুসা ভালো করে খোঁজ-খবর নিয়ে একটা ফিশিং ট্রলার কোম্পানীতে যায়। নিজের পরিচয় দিয়ে বলে যে, সে একজন পর্যটক, ফিশিং তার হবি। তোয়া উপকূলে মাছ শিকার তার বহুদিনের ইচ্ছা। তাকে ভালো ট্রলার ও সহযোগিতার জন্যে জেলে দিয়ে সাহায্য করলে এর জন্যে উপযুক্ত অর্থ দিতে সে রাজি আছে। কোম্পানির মালিক বলে, এর জন্যে তো লাগবে অনেক অর্থ। অত্যাধুনিক ট্রলার যদি নিতে হয়, তাহলে প্রথম ফেরত যোগ্য সিকিউরিটি ডিপোজিট ৫ হাজার মার্কিন ডলার। আর প্রতি ঘণ্টায় ট্রলারের ভাড়া ১০০ ডলার করে। কমপক্ষে ৫ জন জেলে সাথে যাবে। তাদের প্রতিজনের প্রতি ছয় ঘণ্টার কর্মদিনের জন্যে লাগবে ১০০ ডলার করে। ফিশিং সরঞ্জামের ভাড়া লাগবে না। সেটা বোটের ভাড়ার মধ্যে শামিল।
খরচের হিসেব শুনে আহমদ মুসা মনে মনে বলেছিল, এর দ্বিগুণ, কিংবা কয়েকগুণ বেশি দাবি করলেও তোমরা পেতে। কিন্তু মুখে বলেছিল, ট্রলার ভাড়া ও জেলেদের পারিশ্রমিক যা আশা করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি।
কোম্পানীর কর্তা বলেছিল, তাহলে স্যার ফিশিং আইডিয়া ছেড়ে দিন, সেটাই ভাল।
এটাই যদি আপনার শেষ কথা হয়, তাহলে আমাকে রাজি হতেই হবে। অনেক আশা করে আমি এসেছি। বলেছিল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ। সাংঘাতিক ফিশিং হবি তো আপনার! কিন্তু আরেকটি ব্যাপারে আপনাকে রাজি হতে হবে। সেটা হলো, তোয়া উপকূল এলাকায় বর্তমানে খুব কড়াকড়ি চলছে। আপনি যদি ফিশিং অনুমতি না পান কিংবা আপনার কোন বিপদ হয় তার জন্যে আমরা দায়ী থাকব না এবং আমরা ক্ষতিও স্বীকার করব না। দ্বিতীয়ত এক কর্মদিন অর্থাৎ ছয় ঘণ্টার ভাড়া ও পারিশ্রমিক আপনাকে সিকিউরিটি মানির সাথে অগ্রিম জমা দিতে হবে। বলেছিল কোম্পানীর কর্মকর্তা।
আপনাদের এ শর্তও আমি মেনে নিচ্ছি। তবে আমার যদি কোন বিপদ হয়, তবে সেটা আমার আত্মীয়-স্বজনকে আপনাদের জানাতে হবে। আমি নিকোশিয়ার একটা পোষ্ট বক্স নাম্বার দিয়ে যাবো। সেখানে জানালেই আমার আত্মীয়-স্বজনরা তা পেয়ে যাবে। কৃত্রিম বিনীত কণ্ঠে বলেছিল আহমদ মুসা।
এভাবে একটা আধুনিক ফিশিং ট্রলার বোট এবং ৫ জন জেলে নিয়ে যাত্রা করেছে আহমদ মুসা।
বিকেল চারটায় বোট নিয়ে পাফোস থেকে যাত্রা করেছে আহমদ মুসা। আহমদ মুসা বলেছে শেষ রাত এবং সকালেই সে মাছ ধরতে ভালবাসে। সে সন্ধ্যার মধ্যে তোয়া উপকূলে পৌছতে চায়।
পূর্ণ শক্তিতে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসার বোট উপকূলের দিকে।
বোটের পেছন দিকে বোটের চার ভাগের এক ভাগ জায়গায় আধুনিক কেবিন। কেবিনের মাথার উপর ফ্ল্যাগ ষ্ট্যান্ডে উড়ছে ফিশিং পতাকা।
আহমদ মুসা হাতঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে ৫টা বাজে। নব্বই-একশ মাইলের মত এসেছে। আরও পঞ্চাশ-ষাট মাইল বাঁকি। তার মানে আরও এক ঘণ্টা লাগবে তোয়া উপকূলে পৌছতে। সন্ধ্যায় পৌছবে তারা তোয়া উপকূলে। এ রকম একটা সময়ই আহমদ মুসা চায়।
আহমদ মুসার পরিকল্পনা হলো, সাংঘাতিক অসুস্থ হওয়ার কথা বলে সে উপকূলে নেমে সকালে ফিরে আসার কথা বলবে। আর যদি সকালে ফিরতে না পারে, তাহলে ট্রলার যেন চলে যায়। একটা বেয়ারার চেক দিয়ে যাবে, যা ভাঙালে তাদের পাওনা পরিশোধ হয়ে যাবে।
আরও এক ঘণ্টা পার হলো।
তোয়া উপকূলে তারা এসে পৌছেছে। তোয়া দ্বীপের উত্তর উপকূলটা কালো দেয়ালের মত তাদের সামনে। তোয়া দ্বীপ থেকে কোন আলো তারা দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু উপকূলের পানিতে আলোর ছুটোছুটি দেখা যাচ্ছে। পাঁচজন জেলের যে সর্দার সে বলল, স্যার ছুটন্ত যে আলোগুলো দেখছেন, সেগুলো উপকূল গার্ডদের বোটের আলো। আমাদের বোটের আলো দেখলেই দেখবেন তারা ছুটে আসবে।
আমাদের বোটের আলো দেখে তারা বুঝবে কি করে যে, আমাদের এটা উপকূল গার্ডের বোট নয়। অন্ধকারে তো তারা আমাদের বোট দেখতে পাবে না। জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
স্যার, দেখুন ওদের ও আমাদের বোটের আলোর রংয়ে পার্থক্য আছে। দেখুন আমাদের বোটের আলোর রং সম্মোহনকারী হালকা নীলাভ। রাতে মাছ শিকারের জন্যে এই রং খুব কার্যকরী। সব বোটের আলোই এই রংয়ের। কিন্তু ওদের বোটের আলো দেখুন স্বচ্ছ সাদা। বলল জেলেদের সর্দার।
আহমদ মুসাদের বোট তখন ‘তোয়া’ উপকূলের আরও কাছে চলে এসেছে।
এই সময় জেলেদের সর্দার নিকোলাস নেলসন দ্রুতকণ্ঠে বলল, স্যার দেখুন, দু’টি বোট আমাদের দিকে ছুটে আসছে। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
আহমদ মুসাও দেখল দু’টি আলো তীর বেগে তাদের দিকে ছুটে আসছে। আহমদ মুসা বলল, আমি সাইপ্রাসের লোক নই দেখলে তারা আমাকে কি করবে বলে মনে কর?
স্যার, তারা কথা বলে ছেড়েও দিতে পারে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে উর্ধ্বতন অফিসারদের কাছে নিয়েও যেতে পারে। উর্ধ্বতন অফিসাররা ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু স্যার, সন্দেহ হলে তারা নির্ঘাত মেরে ফেলবে। স্যার, এখনকার ওরা মানুষের বাচ্চা নয়। গত সপ্তাহ দুই ধরে এই অবস্থা হয়েছে।’ বলল জেলেদের সর্দার নিকোলাস নেলসন।
আমাকে নিয়ে গেলে তোমরা কি করবে? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
নিয়ে যাবে তারা? আমরা বুঝতে পারছি না স্যার, আপনাকে নিয়ে গেলে আমরা কি করব। আপনিই বলুন।
আমি ভয় করছি না। আমাকে নিয়ে গেলেও তারা ছেড়ে দেবে। সন্দেহের কিছু পাবে না। নিয়ে যদি যায় তাহলে তোমরা অপেক্ষা না করে চলে যেও। আমি যাবার সময় একটা চেক দিয়ে যাব, সেটা পাফোসের ব্যাংকে ভাঙিয়ে পাওনা নিয়ে নিতে পারবে। বলল আহমদ মুসা।
আপনার কথা শুনে আমারই ভয় করছে স্যার। কিন্তু আপনাকে ভীত দেখছি না? বলল জেলেদের সর্দার।
‘ভয় পাব কেন? আমার কোনই অপরাধ নেই। মানুষ মানুষকে ভয় পাবে কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। কিন্তু ওরা তো মানুষ নয়। সামান্য সন্দেহ হলেও ওরা পাখির মত গুলী করে মানুষ মারে। ভয়টা আমার এ জন্যেই। আপনি খুব ভাল মানুষ…….।
কথা শেষ না করেই বলল, স্যার ওরা এসে গেছে।
ঠিক আছে, আসতে দাও। বলল আহমদ মুসা।
এর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দু’দিক থেকে দুই পেট্রল বোট এসে আহমদ মুসাদের বোটের দু’পাশে অবস্থান নিল। দু’পাশের দু’বোট থেকে দু’হুক দিয়ে আহমদ মুসাদের বোটকে ওদের বোটের সাথে আটকে দেয়া হলো।
দু’বোট থেকে দু’অফিসার আহমদ মুসাদের বোটে উঠে এল। তাদের সাথে উঠে এল আরও দু’জন প্রহরী। তাদের হাতে উদ্যত সাব-মেশিনগান, তা তাক করা বোটের লোকদের দিকে।
বোটে উঠেই একজন অফিসার বোটের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, পরিচয়ের কাগজপত্র নিয়ে সার বেধে দাঁড়াও।
জেলেরাসহ আহমদ মুসা সার বেঁধে দাঁড়াল। জেলেদের সবার কাগজপত্র দেখে ওকে করে দিল। কিন্তু অফিসারটি আহমদ মুসার ফিসিং কন্ট্রাক্টের কাগজপত্র ও পাসপোর্ট দেখে বিস্ময়ের সাথে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বলল, জানেন না, ‘তোয়া উপকূলে পর্যটকদের আসা নিষিদ্ধ হয়েছে?
আমি পর্যটক হিসেবে আসিনি, আমি এসেছি এখানে ফিশিং-এর জন্যে। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু নিশ্চয় আপনি জেনেছেন, সাইপ্রাসের নাগরিক ছাড়া অন্য সবার জন্যে ফিশিং এখানে নিষিদ্ধ?
আমি সাইপ্রাসের নই বটে, কিন্তু যাদের নিয়ে আমি ফিশিং এ এসেছি, সবাই সাইপ্রাসের। বোট, ফিশিং সরঞ্জাম, জেলে সবাই সাইপ্রাসের। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু আপনি সাইপ্রাসের নন। অন্যদের ব্যাপারে প্রশ্ন নেই।
কথা শেষ করেই অফিসারটির দিকে চেয়ে বলল, এঁকে আমাদের বেজ ক্যাম্পে নিয়ে যাও। তাঁরা জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখুক।
অফিসারটির কথা শেষ হতেই জেলেদের সর্দার নিকোলাস নেলসন বলল, স্যার, ওঁকে নিয়ে যাবেন না। আমরা ফিশিং করব না, আমরা ফিরে যাচ্ছি সাইপ্রাসে।
ওঁকে ছাড়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। অবাঞ্জিত কেউ আমাদের জলসীমা ও উপকূলে ধরা পড়লে, তাকে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সামনে নিয়ে যেতে হবে। তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, তাঁদের কাছে নামের তালিকা ও ফটোর এ্যালবাম আছে, সে সবের সাথে মিলিয়ে যা ইচ্ছে তারাই করবেন। থামল অফিসার।
থেমেই সে পুলিশ অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বলল, ইলাম, এঁকে সার্চ করে তোমার বোটে তুলে নাও।
ইলাম নামের অফিসার এগিয়ে এল।
আহমদ মুসা নিজের থেকেই হাত তুলে দাঁড়াল।
অফিসারটি এসে আহমদ মুসার জ্যাকেট ও প্যান্টের সবগুলো পকেট সার্চ করল। কমর সার্চ করার সময় চামড়ার খাপে একটা ছুরি পেল সে।
ছুরিটি খুলে নিয়ে অন্য অফিসারটির উদ্দেশ্যে বলল, পকেটে মানিব্যাগ ছাড়া আর কিছু নেই স্যার।
ঠিক আছে তাকে বোটে তুলে নাও। বলল অফিসারটি।
আহমদ মুসা সার্চকারী অফিসারটিকে বলল, একটু সময় দিন।
বলে আহমদ মুসা পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা চেক বের করে জেলেদের সর্দারের হাতে দিয়ে বলল, ব্যাংকে এটা ভাঙিয়ে আপনাদের ও মালিকের পাওনা নিয়ে নেবেন।
কথা শেষ করেই অফিসারটির সাথে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। জেলেদের সর্দার নেলসন বলল, স্যার আমরা কি অপেক্ষা করব না?
না অপেক্ষা করবে না। বলল আহমদ মুসা।
আপনি ফিরবেন কি করে? জিজ্ঞাসা নেলসনের।
যারা আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন, তাদেরই দায়িত্ব হবে আমাকে আমার জায়গায় ফেরত পাঠানো। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা বোটে উঠলে তারপর অফিসারটি বোটে উঠে এল।
সংগে সংগেই বোট ষ্টার্ট নিল।
বোটে অফিসারসহ ওরা পাঁচজন।
আহমদ মুসাকে বোটের সামনে রেখে বোটের মাঝখানে অফিসারসহ চারজন বসল। বোটের পেছনে একজন। বোটকে সেই ড্রাইভ করছে।
বোটের মাঝখানে অফিসার ছাড়া তিনজনের হাতেই ষ্টেনগান। নির্দেশ বা প্রয়োজন হলেই ষ্টেনগানগুলোর নল উঠে আসবে এবং গুলীর বৃষ্টি সৃষ্টি করবে।
বোট দ্রুত চলছে উপকূলের দিকে।
অফিসারটি এক সময় আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, তোমাকে খুব সাহসী ও বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে। কিন্তু তুমি এভাবে ফাঁদে পড়লে কেন?
ফাঁদে কোথায়? জিজ্ঞাসাবাদ তো তোমরা করতেই পার। আহমদ মুসা বলল।
হাসল অফিসারটি। বলল, ফাঁদ নয় ফাঁসি কাষ্টের দিকে তুমি যাচ্ছ। দুঃখের সাথে বলছি, তোমার মত অবাঞ্চিত, অপরিচিত যারা তোয়া দ্বীপে পা রাখে, তারা আর ফিরে যায় না।
আহমদ মুসা ওদের চ্যালেঞ্জ করারই একটা পথ খুঁজছিল। সে সুযোগ পেয়ে বলল, কিন্তু তোমরা আমাকে বলেছ, তোমরা জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে আমাকে নিয়ে যাচ্ছ। এখন বলছ তোমাদের মতলব অন্যরকম। তাহলে তো আমি যাব না।
হেসে উঠল অফিসারটি। বলল, মনে হচ্ছে যাওয়া না যাওয়া তোমার হাতে?
দেখ, আমি এখনও তোমাদের বেজ ক্যাম্পে যাইনি। আমি এখনও মুক্ত।
তোমার সামনে তিনটি ষ্টেনগান আছে দেখতে পাচছ না? নির্দেশ দিলেই হা করে উঠবে তোমার দিকে, তোমাকে ঝাঁঝরা করে দেবে গুলীর বৃষ্টি।
আহমদ মুসা পা মুড়ে বসে ছিল। মুড়ানো তার ডান পা তার ডান ‘হিপ’-এর বাইরে বেরিয়ে ছিল। আহমদ মুসার ডান হাতটা তার ডান পায়ের টাকনুর উপর রাখা ছিল। আর তার পায়ের মোজার ভেতর গুজে রাখা এম-১৬ এর সর্বাধুনিক মিনি সংস্করণ ‘লিটল ক্যানল’ রিভলবারটির বাট আহমদ মুসার ডান হাত স্পর্শ করে আছে। আহমদ মুসার ঠোঁটে ফুটে উঠেছে এক টুকরো হাসি।
সে দুটো আঙুল দিয়ে নাইলনের মোজা ইতিমধ্যেই নামিয়ে দিয়েছে। এবার ‘লিটল ক্যানন’-এর বাঁটে হাত রেখে বলল, তোমরা কি করবে, আমাকে মেরে ফেলবে?
কেন, ক্ষতি কি? যে কাজটা ওরা একটু পরে করবে, সে কাজ আমরা এখন করলে ক্ষতি কি? বরং তারা খুশি হবে এই ভেবে যে, আমরা শেয়ানা হয়েছি।
কিন্তু মি. এ্যারন, শুধু গন্ডাখানেক ষ্টেনগান থাকলেই মানুষকে আটকানো যায় না।’
বলেই আহমদ মুসা রিভলবার সমেত ডান হাত বিদ্যুত বেগে সামনে এনে চারজনকে তাক করল। বলল, তোমরা ষ্টেনগান তোলার চেষ্টা করলে আর মি. এ্যারন তুমি পকেটে হাত দেয়ার চেষ্টা করলে এই ‘লিটল ক্যানন’ ব্রাশ ফায়ার করবে। তোমার হাতের ষ্টেনগান, হাতের রিভলবার বোটে রেখে পানিতে নেমে যাও, আমি তোমাদের মারতে চাই না।
একথা বলার সময় পেছনে ড্রাইভিং-এ বসা লোকটি তার পাশে রাখা ষ্টেনগান তুলতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা এদের সাথে কথা বললেও তার চোখ পেছনের লোকটিকেও কভার করছিল।
কথা বলার মধ্যেই আহমদ মুসার ‘লিটল ক্যানন’ রিভলবারটির ট্রিগার সেকেন্ডের জন্যে চেপে বসল আর সামনে বসা চারজনের মধ্যে দু’জনের ফাঁক দিয়ে কয়েকটা বুলেট ছুটে গিয়ে নিখুঁতভাবে তার মাথায় আঘাত করল।
লোকটির দেহ উল্টে ঝপ করে পানিতে পড়ে গেল।
এরা চারজনই পলকের জন্যে পেছনে তাকিয়ে মরিয়া হয়ে তিনজন তাদের ষ্টেনগানের নল উপরে তুলেছিল। আর অফিসারটিও হাত দিয়েছিল পকেটে।
কিন্তু ঐ পর্যন্তই। আহমদ মুসার তর্জনি ট্রিগারের উপরেই ছিল। তা আবার চেপে বসল ট্রিগারে। আর আহমদ মুসার হাতটি রিভালবারটি ঘুরিয়ে নিল চারজনের ওপর দিয়ে।
মুহূর্তেই চারজনের দেহ ঝরে পড়ল বোটের ওপর।
আহমদ মুসা চারদিকে চেয়ে দেখল, আশেপাশে কোন পেট্রল বোটের আলো দেখা যাচ্ছে না। আর অটো সাইলেন্সারের ‘লিটল ক্যানন’ গুলী করার সময় সামান্য হিস হিস ছাড়া কোন শব্দ করে না।
আহমদ মুসা তার ‘লিটল ক্যানন’-এর নলটা মুছে নিয়ে সেটা আর সে পায়ের মোজায় গুজল না। কাঁধের মধ্যখানে ঘাড়ের নিচে জ্যাকেটের একটা গোপন পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর লাশগুলো পানিতে ফেলে দিল। বোটের আলো নিভিয়ে দিয়ে সে গিয়ে পেছনের ড্রাইভিং সিটে বসল। বোটের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। ফ্লাগ ষ্ট্যান্ডের সাথে বেঁধে রাখা ইমার্জেন্সি ফ্ল্যাগ খুলে ফেলল। তারপর ফ্ল্যাগ ষ্ট্যান্ড খুলে নিয়ে বৈঠা বেয়ে সে চলল উপকূলের দিকে।
অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে নিঃশব্দে চলল বোটটি।
পৌনে এক ঘণ্টার মত বোট চালিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে আহমদ মুসা উপকূলের গাছপালার আড়ালে পৌছে গেল।
তীরের কোথায় কি আছে, কোথায় রাস্তা, কোথায় কোথায় ওদের বেজ ক্যাম্প আছে, এ সম্পর্কে আহমদ মুসার কোন কিছুই জানা নেই। তবে একটা বিষয়ে সে নিশ্চিত, তোয়া দ্বীপের তোয়া শহরটি এবং তোয়ার শাসনকেন্দ্র যেহেতু পূর্ব উপকূলের মাঝামাঝি স্থানে, তাই বোটটি সে উত্তর উপকূলের পূর্ব অংশের কোথাও নোঙর করে স্থলপথে ‘তোয়া’ শহরের দিকে এগোতে চায়। উপকূলের পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যভাগের দুই স্থানে আলো দেখতে পেল আহমদ মুসা। ওগুলো কি কোষ্টাল গার্ডদের বেজ ক্যাম্প? যাই হোক, তার গন্তব্য এটা নয়। তাকে আরও পূর্বে এগোতে হবে।
উপকূল ধরে আরও এগোলো আহমদ মুসা।
পূর্ব প্রান্তের দিকে অনেকটাই চলে এসেছে আহমদ মুসা।
ডান পাশে উপকূলে আরো এক গুচ্ছ আলোর রেখা দেখতে পেল আহমদ মুসা। আর পূর্বে এগোনো নয়, এরই আশেপাশে তাকে নামতে হবে। তার নিশ্চিত ধারণা, ওটা যদি ওদের বেজ ক্যাম্প হয়, তাহলে সে ক্যাম্পের সাথে তোয়া সিটির সংযোগ-রাস্তাও আছে। সেই রাস্তা আহমদ মুসার দরকার।
বোট ঘুরিয়ে নিয়ে উপকূলের আলোটাকে আহমদ মুসা বামে রেখে উপকূলের দিকে এগিয়ে চলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা যাত্রা করেছে দক্ষিণ সাইপ্রাসের পাফোস বন্দর থেকে। বন্দরটি মূলত ফিশিং বন্দর। আহমদ মুসা আগের দিন সাইপ্রাসে এসে থেমেছিল লিমাসোল বন্দরে একজন ট্যুরিষ্টের পরিচয়ে। বৈরুত থেকে সে সাইপ্রাসের ভিসা নিয়েছিল আবু আমরকে দিয়ে দালালের মাধ্যমে। পাসপোর্টে তার হবি লেখা আছে ফিশিং ও ফরেষ্ট ট্যুরে। আহমদ মুসা লিমসোল থেকে কিছু খোঁজ-খবর নিয়ে গতকালই সড়ক পথে এসেছিল দক্ষিণ সাইপ্রাসের সর্বদক্ষিণ বন্দর শহর পাফোসে। এখানে এসে আরও খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছিল, তোয়া উপকূল মাছ শিকারের জন্যে বিখ্যাত। সাইপ্রাস থেকেও জেলেরা মাছ শিকারে মাঝে মাঝে সেখানে যায়। অনুমতি নিয়ে ও রয়্যালটি দিয়ে সেখানে মাছ শিকার করা যায়। তবে কয়েকদিন হলো সেখানে মাছ শিকার ভীষণ কড়াকড়ির মধ্যে পড়েছে। সবাইকে মাছ শিকারের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। কথা বলে খুশি হলে তবেই এই অনুমতি মেলে। দ্বীপে ট্যুরিষ্টদের যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। আইনসংগত ও অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যবসায় ও চাকরির প্রয়োজন ছাড়া সাইপ্রাসবাসিরাও সেখানে যেতে পারে না।
আহমদ মুসা ভালো করে খোঁজ-খবর নিয়ে একটা ফিশিং ট্রলার কোম্পানীতে যায়। নিজের পরিচয় দিয়ে বলে যে, সে একজন পর্যটক, ফিশিং তার হবি। তোয়া উপকূলে মাছ শিকার তার বহুদিনের ইচ্ছা। তাকে ভালো ট্রলার ও সহযোগিতার জন্যে জেলে দিয়ে সাহায্য করলে এর জন্যে উপযুক্ত অর্থ দিতে সে রাজি আছে। কোম্পানির মালিক বলে, এর জন্যে তো লাগবে অনেক অর্থ। অত্যাধুনিক ট্রলার যদি নিতে হয়, তাহলে প্রথম ফেরত যোগ্য সিকিউরিটি ডিপোজিট ৫ হাজার মার্কিন ডলার। আর প্রতি ঘণ্টায় ট্রলারের ভাড়া ১০০ ডলার করে। কমপক্ষে ৫ জন জেলে সাথে যাবে। তাদের প্রতিজনের প্রতি ছয় ঘণ্টার কর্মদিনের জন্যে লাগবে ১০০ ডলার করে। ফিশিং সরঞ্জামের ভাড়া লাগবে না। সেটা বোটের ভাড়ার মধ্যে শামিল।
খরচের হিসেব শুনে আহমদ মুসা মনে মনে বলেছিল, এর দ্বিগুণ, কিংবা কয়েকগুণ বেশি দাবি করলেও তোমরা পেতে। কিন্তু মুখে বলেছিল, ট্রলার ভাড়া ও জেলেদের পারিশ্রমিক যা আশা করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি।
কোম্পানীর কর্তা বলেছিল, তাহলে স্যার ফিশিং আইডিয়া ছেড়ে দিন, সেটাই ভাল।
এটাই যদি আপনার শেষ কথা হয়, তাহলে আমাকে রাজি হতেই হবে। অনেক আশা করে আমি এসেছি। বলেছিল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ। সাংঘাতিক ফিশিং হবি তো আপনার! কিন্তু আরেকটি ব্যাপারে আপনাকে রাজি হতে হবে। সেটা হলো, তোয়া উপকূল এলাকায় বর্তমানে খুব কড়াকড়ি চলছে। আপনি যদি ফিশিং অনুমতি না পান কিংবা আপনার কোন বিপদ হয় তার জন্যে আমরা দায়ী থাকব না এবং আমরা ক্ষতিও স্বীকার করব না। দ্বিতীয়ত এক কর্মদিন অর্থাৎ ছয় ঘণ্টার ভাড়া ও পারিশ্রমিক আপনাকে সিকিউরিটি মানির সাথে অগ্রিম জমা দিতে হবে। বলেছিল কোম্পানীর কর্মকর্তা।
আপনাদের এ শর্তও আমি মেনে নিচ্ছি। তবে আমার যদি কোন বিপদ হয়, তবে সেটা আমার আত্মীয়-স্বজনকে আপনাদের জানাতে হবে। আমি নিকোশিয়ার একটা পোষ্ট বক্স নাম্বার দিয়ে যাবো। সেখানে জানালেই আমার আত্মীয়-স্বজনরা তা পেয়ে যাবে। কৃত্রিম বিনীত কণ্ঠে বলেছিল আহমদ মুসা।
এভাবে একটা আধুনিক ফিশিং ট্রলার বোট এবং ৫ জন জেলে নিয়ে যাত্রা করেছে আহমদ মুসা।
বিকেল চারটায় বোট নিয়ে পাফোস থেকে যাত্রা করেছে আহমদ মুসা। আহমদ মুসা বলেছে শেষ রাত এবং সকালেই সে মাছ ধরতে ভালবাসে। সে সন্ধ্যার মধ্যে তোয়া উপকূলে পৌছতে চায়।
পূর্ণ শক্তিতে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসার বোট উপকূলের দিকে।
বোটের পেছন দিকে বোটের চার ভাগের এক ভাগ জায়গায় আধুনিক কেবিন। কেবিনের মাথার উপর ফ্ল্যাগ ষ্ট্যান্ডে উড়ছে ফিশিং পতাকা।
আহমদ মুসা হাতঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে ৫টা বাজে। নব্বই-একশ মাইলের মত এসেছে। আরও পঞ্চাশ-ষাট মাইল বাঁকি। তার মানে আরও এক ঘণ্টা লাগবে তোয়া উপকূলে পৌছতে। সন্ধ্যায় পৌছবে তারা তোয়া উপকূলে। এ রকম একটা সময়ই আহমদ মুসা চায়।
আহমদ মুসার পরিকল্পনা হলো, সাংঘাতিক অসুস্থ হওয়ার কথা বলে সে উপকূলে নেমে সকালে ফিরে আসার কথা বলবে। আর যদি সকালে ফিরতে না পারে, তাহলে ট্রলার যেন চলে যায়। একটা বেয়ারার চেক দিয়ে যাবে, যা ভাঙালে তাদের পাওনা পরিশোধ হয়ে যাবে।
আরও এক ঘণ্টা পার হলো।
তোয়া উপকূলে তারা এসে পৌছেছে। তোয়া দ্বীপের উত্তর উপকূলটা কালো দেয়ালের মত তাদের সামনে। তোয়া দ্বীপ থেকে কোন আলো তারা দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু উপকূলের পানিতে আলোর ছুটোছুটি দেখা যাচ্ছে। পাঁচজন জেলের যে সর্দার সে বলল, স্যার ছুটন্ত যে আলোগুলো দেখছেন, সেগুলো উপকূল গার্ডদের বোটের আলো। আমাদের বোটের আলো দেখলেই দেখবেন তারা ছুটে আসবে।
আমাদের বোটের আলো দেখে তারা বুঝবে কি করে যে, আমাদের এটা উপকূল গার্ডের বোট নয়। অন্ধকারে তো তারা আমাদের বোট দেখতে পাবে না। জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
স্যার, দেখুন ওদের ও আমাদের বোটের আলোর রংয়ে পার্থক্য আছে। দেখুন আমাদের বোটের আলোর রং সম্মোহনকারী হালকা নীলাভ। রাতে মাছ শিকারের জন্যে এই রং খুব কার্যকরী। সব বোটের আলোই এই রংয়ের। কিন্তু ওদের বোটের আলো দেখুন স্বচ্ছ সাদা। বলল জেলেদের সর্দার।
আহমদ মুসাদের বোট তখন ‘তোয়া’ উপকূলের আরও কাছে চলে এসেছে।
এই সময় জেলেদের সর্দার নিকোলাস নেলসন দ্রুতকণ্ঠে বলল, স্যার দেখুন, দু’টি বোট আমাদের দিকে ছুটে আসছে। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
আহমদ মুসাও দেখল দু’টি আলো তীর বেগে তাদের দিকে ছুটে আসছে। আহমদ মুসা বলল, আমি সাইপ্রাসের লোক নই দেখলে তারা আমাকে কি করবে বলে মনে কর?
স্যার, তারা কথা বলে ছেড়েও দিতে পারে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে উর্ধ্বতন অফিসারদের কাছে নিয়েও যেতে পারে। উর্ধ্বতন অফিসাররা ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু স্যার, সন্দেহ হলে তারা নির্ঘাত মেরে ফেলবে। স্যার, এখনকার ওরা মানুষের বাচ্চা নয়। গত সপ্তাহ দুই ধরে এই অবস্থা হয়েছে।’ বলল জেলেদের সর্দার নিকোলাস নেলসন।
আমাকে নিয়ে গেলে তোমরা কি করবে? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
নিয়ে যাবে তারা? আমরা বুঝতে পারছি না স্যার, আপনাকে নিয়ে গেলে আমরা কি করব। আপনিই বলুন।
আমি ভয় করছি না। আমাকে নিয়ে গেলেও তারা ছেড়ে দেবে। সন্দেহের কিছু পাবে না। নিয়ে যদি যায় তাহলে তোমরা অপেক্ষা না করে চলে যেও। আমি যাবার সময় একটা চেক দিয়ে যাব, সেটা পাফোসের ব্যাংকে ভাঙিয়ে পাওনা নিয়ে নিতে পারবে। বলল আহমদ মুসা।
আপনার কথা শুনে আমারই ভয় করছে স্যার। কিন্তু আপনাকে ভীত দেখছি না? বলল জেলেদের সর্দার।
‘ভয় পাব কেন? আমার কোনই অপরাধ নেই। মানুষ মানুষকে ভয় পাবে কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। কিন্তু ওরা তো মানুষ নয়। সামান্য সন্দেহ হলেও ওরা পাখির মত গুলী করে মানুষ মারে। ভয়টা আমার এ জন্যেই। আপনি খুব ভাল মানুষ…….।
কথা শেষ না করেই বলল, স্যার ওরা এসে গেছে।
ঠিক আছে, আসতে দাও। বলল আহমদ মুসা।
এর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দু’দিক থেকে দুই পেট্রল বোট এসে আহমদ মুসাদের বোটের দু’পাশে অবস্থান নিল। দু’পাশের দু’বোট থেকে দু’হুক দিয়ে আহমদ মুসাদের বোটকে ওদের বোটের সাথে আটকে দেয়া হলো।
দু’বোট থেকে দু’অফিসার আহমদ মুসাদের বোটে উঠে এল। তাদের সাথে উঠে এল আরও দু’জন প্রহরী। তাদের হাতে উদ্যত সাব-মেশিনগান, তা তাক করা বোটের লোকদের দিকে।
বোটে উঠেই একজন অফিসার বোটের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, পরিচয়ের কাগজপত্র নিয়ে সার বেধে দাঁড়াও।
জেলেরাসহ আহমদ মুসা সার বেঁধে দাঁড়াল। জেলেদের সবার কাগজপত্র দেখে ওকে করে দিল। কিন্তু অফিসারটি আহমদ মুসার ফিসিং কন্ট্রাক্টের কাগজপত্র ও পাসপোর্ট দেখে বিস্ময়ের সাথে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বলল, জানেন না, ‘তোয়া উপকূলে পর্যটকদের আসা নিষিদ্ধ হয়েছে?
আমি পর্যটক হিসেবে আসিনি, আমি এসেছি এখানে ফিশিং-এর জন্যে। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু নিশ্চয় আপনি জেনেছেন, সাইপ্রাসের নাগরিক ছাড়া অন্য সবার জন্যে ফিশিং এখানে নিষিদ্ধ?
আমি সাইপ্রাসের নই বটে, কিন্তু যাদের নিয়ে আমি ফিশিং এ এসেছি, সবাই সাইপ্রাসের। বোট, ফিশিং সরঞ্জাম, জেলে সবাই সাইপ্রাসের। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু আপনি সাইপ্রাসের নন। অন্যদের ব্যাপারে প্রশ্ন নেই।
কথা শেষ করেই অফিসারটির দিকে চেয়ে বলল, এঁকে আমাদের বেজ ক্যাম্পে নিয়ে যাও। তাঁরা জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখুক।
অফিসারটির কথা শেষ হতেই জেলেদের সর্দার নিকোলাস নেলসন বলল, স্যার, ওঁকে নিয়ে যাবেন না। আমরা ফিশিং করব না, আমরা ফিরে যাচ্ছি সাইপ্রাসে।
ওঁকে ছাড়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। অবাঞ্জিত কেউ আমাদের জলসীমা ও উপকূলে ধরা পড়লে, তাকে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সামনে নিয়ে যেতে হবে। তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, তাঁদের কাছে নামের তালিকা ও ফটোর এ্যালবাম আছে, সে সবের সাথে মিলিয়ে যা ইচ্ছে তারাই করবেন। থামল অফিসার।
থেমেই সে পুলিশ অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বলল, ইলাম, এঁকে সার্চ করে তোমার বোটে তুলে নাও।
ইলাম নামের অফিসার এগিয়ে এল।
আহমদ মুসা নিজের থেকেই হাত তুলে দাঁড়াল।
অফিসারটি এসে আহমদ মুসার জ্যাকেট ও প্যান্টের সবগুলো পকেট সার্চ করল। কমর সার্চ করার সময় চামড়ার খাপে একটা ছুরি পেল সে।
ছুরিটি খুলে নিয়ে অন্য অফিসারটির উদ্দেশ্যে বলল, পকেটে মানিব্যাগ ছাড়া আর কিছু নেই স্যার।
ঠিক আছে তাকে বোটে তুলে নাও। বলল অফিসারটি।
আহমদ মুসা সার্চকারী অফিসারটিকে বলল, একটু সময় দিন।
বলে আহমদ মুসা পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা চেক বের করে জেলেদের সর্দারের হাতে দিয়ে বলল, ব্যাংকে এটা ভাঙিয়ে আপনাদের ও মালিকের পাওনা নিয়ে নেবেন।
কথা শেষ করেই অফিসারটির সাথে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। জেলেদের সর্দার নেলসন বলল, স্যার আমরা কি অপেক্ষা করব না?
না অপেক্ষা করবে না। বলল আহমদ মুসা।
আপনি ফিরবেন কি করে? জিজ্ঞাসা নেলসনের।
যারা আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন, তাদেরই দায়িত্ব হবে আমাকে আমার জায়গায় ফেরত পাঠানো। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা বোটে উঠলে তারপর অফিসারটি বোটে উঠে এল।
সংগে সংগেই বোট ষ্টার্ট নিল।
বোটে অফিসারসহ ওরা পাঁচজন।
আহমদ মুসাকে বোটের সামনে রেখে বোটের মাঝখানে অফিসারসহ চারজন বসল। বোটের পেছনে একজন। বোটকে সেই ড্রাইভ করছে।
বোটের মাঝখানে অফিসার ছাড়া তিনজনের হাতেই ষ্টেনগান। নির্দেশ বা প্রয়োজন হলেই ষ্টেনগানগুলোর নল উঠে আসবে এবং গুলীর বৃষ্টি সৃষ্টি করবে।
বোট দ্রুত চলছে উপকূলের দিকে।
অফিসারটি এক সময় আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, তোমাকে খুব সাহসী ও বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে। কিন্তু তুমি এভাবে ফাঁদে পড়লে কেন?
ফাঁদে কোথায়? জিজ্ঞাসাবাদ তো তোমরা করতেই পার। আহমদ মুসা বলল।
হাসল অফিসারটি। বলল, ফাঁদ নয় ফাঁসি কাষ্টের দিকে তুমি যাচ্ছ। দুঃখের সাথে বলছি, তোমার মত অবাঞ্চিত, অপরিচিত যারা তোয়া দ্বীপে পা রাখে, তারা আর ফিরে যায় না।
আহমদ মুসা ওদের চ্যালেঞ্জ করারই একটা পথ খুঁজছিল। সে সুযোগ পেয়ে বলল, কিন্তু তোমরা আমাকে বলেছ, তোমরা জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে আমাকে নিয়ে যাচ্ছ। এখন বলছ তোমাদের মতলব অন্যরকম। তাহলে তো আমি যাব না।
হেসে উঠল অফিসারটি। বলল, মনে হচ্ছে যাওয়া না যাওয়া তোমার হাতে?
দেখ, আমি এখনও তোমাদের বেজ ক্যাম্পে যাইনি। আমি এখনও মুক্ত।
তোমার সামনে তিনটি ষ্টেনগান আছে দেখতে পাচছ না? নির্দেশ দিলেই হা করে উঠবে তোমার দিকে, তোমাকে ঝাঁঝরা করে দেবে গুলীর বৃষ্টি।
আহমদ মুসা পা মুড়ে বসে ছিল। মুড়ানো তার ডান পা তার ডান ‘হিপ’-এর বাইরে বেরিয়ে ছিল। আহমদ মুসার ডান হাতটা তার ডান পায়ের টাকনুর উপর রাখা ছিল। আর তার পায়ের মোজার ভেতর গুজে রাখা এম-১৬ এর সর্বাধুনিক মিনি সংস্করণ ‘লিটল ক্যানল’ রিভলবারটির বাট আহমদ মুসার ডান হাত স্পর্শ করে আছে। আহমদ মুসার ঠোঁটে ফুটে উঠেছে এক টুকরো হাসি।
সে দুটো আঙুল দিয়ে নাইলনের মোজা ইতিমধ্যেই নামিয়ে দিয়েছে। এবার ‘লিটল ক্যানন’-এর বাঁটে হাত রেখে বলল, তোমরা কি করবে, আমাকে মেরে ফেলবে?
কেন, ক্ষতি কি? যে কাজটা ওরা একটু পরে করবে, সে কাজ আমরা এখন করলে ক্ষতি কি? বরং তারা খুশি হবে এই ভেবে যে, আমরা শেয়ানা হয়েছি।
কিন্তু মি. এ্যারন, শুধু গন্ডাখানেক ষ্টেনগান থাকলেই মানুষকে আটকানো যায় না।’
বলেই আহমদ মুসা রিভলবার সমেত ডান হাত বিদ্যুত বেগে সামনে এনে চারজনকে তাক করল। বলল, তোমরা ষ্টেনগান তোলার চেষ্টা করলে আর মি. এ্যারন তুমি পকেটে হাত দেয়ার চেষ্টা করলে এই ‘লিটল ক্যানন’ ব্রাশ ফায়ার করবে। তোমার হাতের ষ্টেনগান, হাতের রিভলবার বোটে রেখে পানিতে নেমে যাও, আমি তোমাদের মারতে চাই না।
একথা বলার সময় পেছনে ড্রাইভিং-এ বসা লোকটি তার পাশে রাখা ষ্টেনগান তুলতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা এদের সাথে কথা বললেও তার চোখ পেছনের লোকটিকেও কভার করছিল।
কথা বলার মধ্যেই আহমদ মুসার ‘লিটল ক্যানন’ রিভলবারটির ট্রিগার সেকেন্ডের জন্যে চেপে বসল আর সামনে বসা চারজনের মধ্যে দু’জনের ফাঁক দিয়ে কয়েকটা বুলেট ছুটে গিয়ে নিখুঁতভাবে তার মাথায় আঘাত করল।
লোকটির দেহ উল্টে ঝপ করে পানিতে পড়ে গেল।
এরা চারজনই পলকের জন্যে পেছনে তাকিয়ে মরিয়া হয়ে তিনজন তাদের ষ্টেনগানের নল উপরে তুলেছিল। আর অফিসারটিও হাত দিয়েছিল পকেটে।
কিন্তু ঐ পর্যন্তই। আহমদ মুসার তর্জনি ট্রিগারের উপরেই ছিল। তা আবার চেপে বসল ট্রিগারে। আর আহমদ মুসার হাতটি রিভালবারটি ঘুরিয়ে নিল চারজনের ওপর দিয়ে।
মুহূর্তেই চারজনের দেহ ঝরে পড়ল বোটের ওপর।
আহমদ মুসা চারদিকে চেয়ে দেখল, আশেপাশে কোন পেট্রল বোটের আলো দেখা যাচ্ছে না। আর অটো সাইলেন্সারের ‘লিটল ক্যানন’ গুলী করার সময় সামান্য হিস হিস ছাড়া কোন শব্দ করে না।
আহমদ মুসা তার ‘লিটল ক্যানন’-এর নলটা মুছে নিয়ে সেটা আর সে পায়ের মোজায় গুজল না। কাঁধের মধ্যখানে ঘাড়ের নিচে জ্যাকেটের একটা গোপন পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর লাশগুলো পানিতে ফেলে দিল। বোটের আলো নিভিয়ে দিয়ে সে গিয়ে পেছনের ড্রাইভিং সিটে বসল। বোটের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। ফ্লাগ ষ্ট্যান্ডের সাথে বেঁধে রাখা ইমার্জেন্সি ফ্ল্যাগ খুলে ফেলল। তারপর ফ্ল্যাগ ষ্ট্যান্ড খুলে নিয়ে বৈঠা বেয়ে সে চলল উপকূলের দিকে।
অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে নিঃশব্দে চলল বোটটি।
পৌনে এক ঘণ্টার মত বোট চালিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে আহমদ মুসা উপকূলের গাছপালার আড়ালে পৌছে গেল।
তীরের কোথায় কি আছে, কোথায় রাস্তা, কোথায় কোথায় ওদের বেজ ক্যাম্প আছে, এ সম্পর্কে আহমদ মুসার কোন কিছুই জানা নেই। তবে একটা বিষয়ে সে নিশ্চিত, তোয়া দ্বীপের তোয়া শহরটি এবং তোয়ার শাসনকেন্দ্র যেহেতু পূর্ব উপকূলের মাঝামাঝি স্থানে, তাই বোটটি সে উত্তর উপকূলের পূর্ব অংশের কোথাও নোঙর করে স্থলপথে ‘তোয়া’ শহরের দিকে এগোতে চায়। উপকূলের পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যভাগের দুই স্থানে আলো দেখতে পেল আহমদ মুসা। ওগুলো কি কোষ্টাল গার্ডদের বেজ ক্যাম্প? যাই হোক, তার গন্তব্য এটা নয়। তাকে আরও পূর্বে এগোতে হবে।
উপকূল ধরে আরও এগোলো আহমদ মুসা।
পূর্ব প্রান্তের দিকে অনেকটাই চলে এসেছে আহমদ মুসা।
ডান পাশে উপকূলে আরো এক গুচ্ছ আলোর রেখা দেখতে পেল আহমদ মুসা। আর পূর্বে এগোনো নয়, এরই আশেপাশে তাকে নামতে হবে। তার নিশ্চিত ধারণা, ওটা যদি ওদের বেজ ক্যাম্প হয়, তাহলে সে ক্যাম্পের সাথে তোয়া সিটির সংযোগ-রাস্তাও আছে। সেই রাস্তা আহমদ মুসার দরকার।
বোট ঘুরিয়ে নিয়ে উপকূলের আলোটাকে আহমদ মুসা বামে রেখে উপকূলের দিকে এগিয়ে চলল আহমদ মুসা।
অধ্যায়-৬
অধ্যায়-৮
অধ্যায়-৯