
সমসাময়িক অন্যান্য নেতার মতো ইতালিয়ানদের প্রস্তাব করা সুযোগ সুবিধার কাছে নিজেকে বিকিয়ে না দিয়ে, ৭৩ বছর বয়স পর্যন্ত লড়াই করে অবশেষে তিনি ইতালিয়ানদের হাতে ধরা পড়েন। প্রহসনের এক বিচারের মাধ্যমে ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকার ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যদণ্ড দেয়।
ওমর আল-মুখতার; Source: Wikimedia Commons
ওমরের বাল্যকাল এবং তার উপর সেনুসি আন্দোলনের প্রভাব
ওমর আল-মুখতারের জন্ম ১৮৫৮ সালে (মতান্তরে ১৮৬২ সালে), লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের তবরুক শহরের নিকটবর্তী জাওইয়াত জাঞ্জুর নামক গ্রামে, মানফি নামক এক আরব বেদুইন গোত্রে। ওমরের বয়স যখন ১৬ বছর, তখন তারা বাবা হজ করতে গিয়ে ইন্তেকাল করেন। বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী, এতিম ওমরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন স্থানীয় সেনুসি শেখ শেরিফ আল-গারিয়ানি।সে সময় লিবিয়াতে সেনুসি আন্দোলনের বেশ প্রভাব ছিল। এই আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয় মক্কায়, ১৮৩৭ সালে। এর প্রবর্তক ছিলেন দ্য গ্র্যান্ড সেনুসি, মোহাম্মদ বিন আলি আস্-সেনুসি, যিনি ছিলেন পরবর্তীতে লিবিয়ার রাজা মোহাম্মদ ইদ্রিস আল-সেনুসির দাদা। দাবি করা হয়, তারা ছিলেন হযরত ফাতিমা (রা) এর দিক থেকে রাসূল (সা) এর বংশধর। সেনুসি আন্দোলন মূলত সুফি এবং সালাফির মাঝামাঝি দর্শনের একটি ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক সংস্কারমূলক আন্দোলন। মক্কায় যাত্রা শুরু করলেও সেনুসি আন্দোলন সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে লিবিয়া, সুদান, মরক্কো সহ উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে।

সেনুসি যোদ্ধারা মিসরে যাচ্ছে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য; Source: Wikimedia Commons
ওমর আল-মুখতার অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতের সাথে আদায় করতেন। রাতে তিনি তিন-চার ঘণ্টার বেশি ঘুমুতেন না। রাত গভীর থাকতেই তিনি ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করতেন। প্রতি সপ্তাহে তিনি একবার কুরআন শরিফ খতম করতেন। তার ধর্মজ্ঞান এবং শিক্ষক হিসেবে সুনামে মুগ্ধ হয়ে সেনুসি কর্তৃপক্ষ তাকে কুরআনের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে সুদানে প্রেরণ করে।
ফরাসীদের বিরুদ্ধে চাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ
১৮৯৪ সালে ওমর আল-মুখতার সুদানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এ সময় আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলোর আগ্রাসন চলছিল। ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তি যখন চাদ দখল করে আরো উত্তরে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে, তখন সেনুসিরা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করে। ১৮৯৯ সালে ওমর আল-মুখতার তৎকালীন সেনুসিদের প্রধান, মোহাম্মদ আল-মাহদির নির্দেশে সেনুসি যোদ্ধাদের সাথে যোগ দিয়ে চাদে যান। ১৮৯৯ সাল থেকে ১৯০০ সালে চাদের নেতা রাবিয়া আজ-জুবায়েরের পতনের পূর্ব পর্যন্ত এই দু’বছর ওমর চাদে ফরাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ওমর এবং তার সেনুসি সহযোদ্ধারা পরবর্তীতে অল্প কিছুদিন মিসরে ব্রিটিশদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করেন।
ওমর আল-মুখতার; Source: Pinterest
ইতালো-তার্কিশ যুদ্ধে অংশগ্রহণ
১৯১১ সালে ইতালিয়ানরা লিবিয়া আক্রমণ করে। সেসময় লিবিয়া ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে তিনটি প্রদেশে বিভক্ত- পশ্চিমের ত্রিপলীতানিয়া, পূর্বের সাইরেনাইকা বা বারকা এবং দক্ষিণের ফেজ্জান। অটোমান সাম্রাজ্যের শক্তি তখন ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছিল। কাজেই ইতালিয়ানরা যখন লিবিয়ার উপকূলে এসে অটোমান সাম্রাজ্যের কাছে লিবিয়াকে হস্তান্তর করার নির্দেশ দেয়, তখন তারা যুদ্ধ না করে ইতালিয়ানদের সাথে সমঝোতায় গিয়ে লিবিয়ার আংশিক নিয়ন্ত্রণ ইতালির হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল।
১৯১১ সালে ইতালিয়ান সৈন্যদের ত্রিপলীতে প্রবেশ; Source: Wikimedia Commons
ইতালিয়ানদের আক্রমণের সময় ওমর আল-মুখতার ছিলেন জালো উদ্যানে। সংবাদ পেয়েই সাথে সাথে তিনি জাওইয়াত আল-কুসুরে যান এবং সেখানকার স্থানীয় আল-আবীদ গোত্রের সক্ষম সকল পুরুষকে দখলদার ইতালিয়ান বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করেন। তাদেরকে সাথে নিয়ে ওমর বীরদর্পে ইতালিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং পূর্বাঞ্চলীয় সাইরেনাইকার অধিকাংশ এলাকাকে ইতালির কাছে পতনের হাত থেকে রক্ষা করেন। ইতালিয়ানদের সাথে স্থানীয় লিবিয়ান এবং অটোমান তুর্কি সেনাদের এ যুদ্ধ ইতিহাসে ইতালো-তার্কিশ যুদ্ধ নামে পরিচিত।

ত্রিপলীতে ইতালিয়ানদের ঘাঁটি; Source: Wikimedia Commons
সেনুসিদের প্রধান আহমেদ শেরিফ আস্-সেনুসি এবং তার ভ্রাতুস্পুত্র মোহাম্মদ ইদ্রিস প্রথম দিকে ইতালির বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে নেতৃত্ব দিলেও, অটোমানরা চলে যাওয়ার পর তারাও লড়াইয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ১৯১৩ সালে আহমেদ শেরিফ অবসর নিলে মোহাম্মদ ইদ্রিস সেনুসিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তিনি ইতালিয়ানদের সাথে যুদ্ধের পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের সমঝোতা এবং ব্রিটিশদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন।

জাঞ্জুরের একদল লিবিয়ান যোদ্ধা ইতালিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাচ্ছে; Source: cevaplar.Org
মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট সরকারের রিকনকুইস্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব
পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে ১৯২২ সালে, যখন ইতালিতে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায় আসে। তারা ক্ষমতায় এসেই অটোমানদের সাথে এবং ইদ্রিস আল-সেনুসির সাথে করা বিভিন্ন সমোঝতা চুক্তি বাতিল করে। ১৯২৩ সালে মুসোলিনির সরকার ‘রিকনকুইস্তা’ বা পুনর্বিজয় নামে একটি প্রকল্প শুরু করে, যার উদ্দেশ্য ছিল যেকোনো উপায়ে প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ত্রিপলী এবং বেনগাজীর কলোনিগুলোকে পুনরায় ইতালির অধীনস্থ করা। জেনারেল পিয়েত্রো বাদুলিওর নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট ইতালীয় বাহিনী নতুন করে সম্পূর্ণ লিবিয়া দখলের জন্য অভিযান শুরু করে।প্রতিরোধ সৃষ্টি না করে আমির ইদ্রিস এ সময় মিসরে চলে যান। ওমর আল-মুখতারের ছোটবেলার পৃষ্ঠপোষক, আরেক গুরুত্বপূর্ণ সেনুসি নেতা শেরিফ আল-গারিয়ানিও ইদ্রিসের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, অল্প সংখ্যক যোদ্ধা নিয়ে বিশাল ইতালিয়ান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় লাভ করা যাবে না। বরং এতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী আরও বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ফলে তিনিও ইতালিয়ানদের আধিপত্য মেনে নিয়ে তাদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে যতটুকু পাওয়া যায়, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে আগ্রহী হন। এ সময় এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে ওমরের সাথে শেরিফ এবং ইদ্রিসের দূরত্ব তৈরি হয়।

আল-মাগরুন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী লিবিয়ানরা; Source: Wikimedia Commons
১৯২৩ সালে ওমর আল-মুখতার মিসরে যান তার যোদ্ধাদের জন্য খাবার এবং অস্ত্রশস্ত্র আনার জন্য। সেখানে তিনি ইদ্রিস আল-সেনুসির সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু তার কাছ থেকে তেমন কোনো সাহায্য না পেয়ে তিনি লিবিয়াতে ফিরে আসেন। সেখানে অবস্থানকালে এক ইতালিয়ান কর্মকর্তা তাকে ইতালিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করার বিনিময়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং লিবিয়াতে ফিরে এসে যুদ্ধের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি তুরস্কে অবস্থানরত অবসরপ্রাপ্ত সেনুসি নেতা আহমেদ আল-শেরিফ আল-সেনুসিকে একটি চিঠি পাঠিয়ে তাদের নীরবতার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং জানান যে, তাদেরকে নেতৃত্বশূন্য করে রেখে গেলেও, তারা তাদের যুদ্ধ ঠিকই চালিয়ে যাবেন।
ওমরের মুজাহিদ বাহিনীকে দমন করতে না পেরে ইতালিয়ান বাহিনী স্থানীয় লোকালয়ের উপর আক্রমণ শুরু করে। স্থানীয় জনগণ যেন ওমরকে সাহায্য না করতে পারে, সেজন্য ইতালিয়ানরা জনগণ এবং তাদের গবাদিপশুর উপর বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করত, লোকালয়ে বিষাক্ত গ্যাস ছিটিয়ে দিত, পানির কূপগুলোতে বিষ ঢেলে দিত, বন্দীদেরকে নির্যাতন করার পর প্লেন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিত এবং রাজবন্দীদেরকে জনসমক্ষে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করত।

লিবিয়ান মুজাহিদদের সাথে ওমর আল-মুখতার; Source: Wikimedia Commons
১৯২৪-২৫ সালে কয়েকটি যুদ্ধে ওমর আল-মুখতারের বাহিনী ইতালিয়ানদের হাতে পরাজিত হলেও, শীঘ্রই তিনি তার রণকৌশলে পরিবর্তন আনেন। ১৯২৭-২৮ সালের দিকে ওমর সেনুসি যোদ্ধাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পুনর্গঠিত করেন। তিনি বিভিন্ন এলাকায় পৃথক পৃথকভাবে যুদ্ধরত দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করেন। তারা অকস্মাৎ ইতালিয়ান বাহিনীর বিভিন্ন চেকপয়েন্টে, তাদের রসদ বহনকারী গাড়ির বহরে এবং তাদের স্থাপিত টেলিগ্রাফ লাইনে আক্রমণ করেই আবার আত্মগোপন করতেন। সে সময়ের ইতালিয়ান জেনারেল তেরুজ্জি ওমরকে ব্যতিক্রমধর্মী, অধ্যাবসায়ী এবং কঠোর ইচ্ছাশক্তির অধিকারী বলে বর্ণনা করেন।
ওমর আল-মুখতারকে গ্রেপ্তার করে লিবিয়ার বিদ্রোহ চূড়ান্তভাবে দমন করার জন্য ইতালির ফ্যাসিস্ট নেতা বেনিতো মুসোলিনি ১৯২৮ সালে রুডলফ গ্র্যাজিয়ানিকে দায়িত্ব দিয়ে লিবিয়াতে পাঠান। গ্র্যাজিয়ানি লিবিয়াতে আসেন এই শর্তে যে, তিনি লিবিয়া শাসনের ব্যাপারে কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন মেনে চলবেন না। বিদ্রোহ দমনের জন্য যা করা প্রয়োজন, তা-ই করবেন।

ইতালিয়ানদের সাথে বৈঠকে শেরিফ আল-গারিয়ানি (বামে) এবং ওমর (বাম থেকে দ্বিতীয়); Source: Wikimedia Commons
ওমরের সেনুসি যোদ্ধারা যেন মিসর এবং সুদান থেকে কোনো অস্ত্র সাহায্য না পায়, সেজন্য গ্র্যাজিয়ানি লিবিয়ার সীমান্ত বরাবর প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করেন। স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে পাওয়া সাহায্য বন্ধ করার জন্য তিনি পুরো লিবিয়া জুড়ে বিশাল বিশাল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প স্থাপন করেন এবং জাবাল আল-আখদারের প্রায় সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠীকে এসব ক্যাম্পে স্থানান্তর করেন। প্রচণ্ড অত্যাচারে এবং অনাহারে এসব কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের এক লাখ বন্দীর প্রায় অর্ধেকই মৃত্যুবরণ করে।
গ্রেপ্তার, বিচার এবং মৃত্যুদণ্ড

গ্রেপ্তারের পর ওমরের পায়ে শিকল পরাচ্ছে ইতালিয়ানরা; Source: Wikimedia Commons
ওমর আল-মুখতার প্রতি বছরই অন্তত একবার তার নিজের প্রতিরোধ কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে অন্যান্য প্রতিরোধকেন্দ্রগুলোতে যেতেন তাদের অবস্থা পরিদর্শনের জন্য। তাদের সাথে প্রতিবারই শতাধিক যোদ্ধা থাকত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু গ্র্যাজিয়ানির আক্রমণে পরিস্থিতি দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছিল। তাই ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বরে মাত্র ৪০ জন সঙ্গী নিয়ে যাত্রা শুরু করেন ওমর। ১১ সেপ্টেম্বরে তারা যখন আল-বেইদার নিকটবর্তী জাবাল আল-আখাদরের সোলোন্তা নামক এলাকায় একটি খাল পার হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তখন স্থানীয় আরব রাজাকারদের কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে ইতালিয়ান বাহিনী তাদেরকে চারদিক থাকে ঘিরে ফেলে এবং তাদের উপর আক্রমণ শুরু করে।

গ্রেপ্তারকৃত অবস্থায় ওমর আল-মুখতার; Source: histoireislamique.wordpress.com
ওমরের বিচার এবং মৃত্যুদণ্ড প্রত্যক্ষ করার জন্য জেনারেল গ্র্যাজিয়ানি রোম থেকে ছুটে আসেন। তিনি ওমরকে জিজ্ঞেস করেন, তারা আসলেই ইতালির মতো পরাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করার আশা করত কিনা। উত্তরে ওমর বলেন, “যুদ্ধ করাটা আমাদের কর্তব্য, আর বিজয় আসবে আল্লাহ্র কাছ থেকে।”

লায়ন অফ দ্য ডেজার্ট চলচ্চিত্রে গ্রেপ্তারকৃত ওমর চরিত্রে অ্যান্থনি কুইন; Source: United Film Distribution Company
ইতালিয়ানরা ওমরের জন্য এক প্রহসনমূলক বিচারের আয়োজন করে। মাত্র তিন দিনের মধ্যে তার বিচার সম্পন্ন করে তারা তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। রায় শুনে ওমর আল-মুখতার পবিত্র কুরআন শরিফ থেকে উচ্চারণ করেন, “নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহ্র জন্য, এবং তার কাছেই আমরা ফিরে যাব।”
১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, বুধবার, বেনগাজীর নিকটবর্তী সুলুক শহরে ওমর আল-মুখতারের ফাঁসির আয়োজন করা হয়। লিবিয়ানদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য ইতালিয়ানরা প্রায় ২০,০০০ মানুষকে ফাঁসির ময়দানে উপস্থিত করে। সকাল নয়টার সময় প্রকাশ্য ময়দানে জনসমক্ষে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। শহীদ হন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম এক বীর যোদ্ধা, যিনি পরাজয় নিশ্চিত জেনেও অন্যায়ের কাছে কখনও মাথা নত করেননি। ৭৩ বছর বয়সে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত যিনি লড়ে গেছেন দখলদার বাহিনীর হাত থেকে নিজের দেশকে মুক্ত করার জন্য।
ওমর আল-মুখতারের স্মরণীয় গাঁথা
ওমরকে ফাঁসি দেওয়ার মধ্য দিয়ে ইতালিয়ানরা সেনুসি আন্দোলন এবং লিবিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম দমন করতে সক্ষম হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইতিহাস ওমরের নামই শ্রদ্ধা সহকারে স্বর্ণের অক্ষরে লিখে রেখেছে। গ্র্যাজিয়ানি সহ ইতালিয়ান জেনারেলদের নামই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গ্র্যাজিয়ানি সহ অনেকেরই যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার এবং শাস্তি হয়েছে। অন্যদিকে ওমর আল-মুখতার পরিণত হয়েছেন শুধু লিবিয়া না, পুরো আরব এবং মুসলিম বিশ্বের সংগ্রামের প্রতীকে।
লিবিয়ান ১০ দিনারের নোটে ওমরের ছবি; Source: moneycollection.tistory.com
গাদ্দাফী ক্ষমতা দখল করেন ১ সেপ্টেম্বর। কিন্তু তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে প্রথম ভাষণ দেন ১৬ সেপ্টেম্বর, ওমর আল-মুখতারের শাহাদাত দিবসে। এবং ভাষণটি তিনি দিয়েছিলেন বেনগাজীতে ওমর আল-মুখতারের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে। গাদ্দাফী ওমর আল-মুখতারের ইতালি বিরোধী যুদ্ধের নেতৃত্বকে জনগণের সামনে তুলে ধরার মাধ্যমে নিজের পশ্চিমাবিশ্ব বিরোধী অবস্থানকে আরও জনপ্রিয় করে তোলেন।

ইতালি ভ্রমণের সময় গাদ্দাফীর জামায় ওমরের ছবি; Source: information.dk
গাদ্দাফীর উদ্যোগে সিরীয়-আমেরিকান পরিচালক ওমর আল-মুখতারের শেষ বছরগুলো নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ‘লায়ন অফ দ্য ডেজার্ট’ নামে এ চলচ্চিত্রটি আরব বিশ্বে ক্লাসিক হিসেবে পরিচিত হয়। ২০১০ সালে গাদ্দাফী যখন ইতালি ভ্রমণে যান, তখন তিনি ঔপনিবেশিক ইতালির লিবিয়ার উপর শোষণের প্রতিবাদ হিসেবে ওমর আল-মুখতারের বন্দী অবস্থায় শিকল পরা ছবিটি তার জামার বুকে ধারণ করেন। ইতালির প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি সে সময় ইতালির অতীতের ভূমিকার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

‘লায়ন অফ দ্য ডেজার্ট’ চলচ্চিত্রের ওমর চরিত্র; Source: United Film Distribution
গাদ্দাফীর মৃত্যুর পর লিবিয়ার পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত সহ সবকিছু আমূল পরিবর্তিত হয়ে গেলেও ওমর আল-মুখতারের প্রতি লিবিয়ানদের শ্রদ্ধা আগের মতোই আছে। তিনি সকল প্রকার রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে। যতদিন লিবিয়া থাকবে, যতদিন আরব বিশ্ব থাকবে, যতদিন বহিঃশক্তির আগ্রাসন এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম থাকবে, ততদিন পর্যন্ত ওমরের স্মৃতি মানুষের হৃদয়ে অটুট থাকবে।
সেনুসিদের নেতা মোহাম্মদ আল-মাহদি আস্-সেনুসি ওমর আল-মুখতার সম্পর্কে ঠিকই বলেছিলেন, “বিশ্বে নির্যাতিত মুসলমানদের বিজয়ের জন্য ওমরের মতো শুধু দশ জন নেতা দরকার।”
No comments:
Post a Comment