এরদোয়ান যেভাবে মুসলিম বিশ্বের নেতা হচ্ছে

আর্ন্তজাতিক রাজনীতিতে তুরস্ক এখন গুরুত্বপূর্ন ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছে। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের যে কোনো ঘটনায় তুরস্ক এখন সরব। কার্যত তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান মুসলিম বিশ্বের নেতায় পরিনত হয়েছেন।
তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিতে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযানে চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে। মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠে নিন্দা ও সমালোচনা করেছে তুরস্ক। আর তা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান।
একের পর এক বক্তব্য ও বিবৃতি দিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের আন্তর্জাতিক কণ্ঠে পরিণত হওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। জাতিসঙ্ঘেও তিনি সরব ছিলেন। রোহিঙ্গা সংকটসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন ইস্যুতে তুরস্কের নেতৃত্বস্থানে আসতে চাওয়ার নেপথ্যে বেশ কিছু কারণ বিশ্লেষণ করে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক অলাভজনক ও গবেষণাধর্মী সংবাদমাধ্যম দ্য কনভারসেশন। এই প্রতিবেদনে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির কিছু বিশ্লেষন করা হয়েছে।

বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা
বৈশ্বিক নেতৃত্ব থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের সরে যাওয়ার ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়ে তা এক্ষেত্রে কিছু ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু মূলত তুরস্কের দীর্ঘদিনের পশ্চিমাপন্থী মনোভাব পাল্টে গেছে। তুরস্ক পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য এবং কয়েক বছর ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য হওয়ার জন্য আগ্রহী ও চেষ্টায় ছিল। কিন্তু এরদোয়ানের নেতৃত্ব ও ক্ষমতাসীন একেপি সরকারের পররাষ্ট্রনীতি এখন দক্ষিণমুখী হয়ে পড়েছে নতুন সুবিধা লাভের আশায়।

বিলকেন্ট ইউনিভার্সিটির অ্যাকাডেমিক পিনার বিলজেন ও আলি বিলজিক তুরস্কের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিকে ‘সিভিলাইজেশনাল জিওপলিটিকস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যা সংস্কৃতি ও সভ্যতার মাপকাঠিতে আন্তর্জাতিক আচরণ নির্ধারণের পন্থা।
বিলজিন ও বিলজিক যুক্তি তুলে ধরে বলেন, নতুন এই মতবাদ তুরস্ককে পশ্চিমা ও এশিয়ার বাকি অংশের ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রে স্থাপন করেছে। রাজনৈতিক ঐতিহ্যের মাধ্যমে এই বৈশ্বিক হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে সেন্ট্রাল এশিয়ান ও অটোমান ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে।

তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির এই পরিবর্তন শুরু হয় একুশ শতকের প্রথম দশকের শেষ দিকে। এই পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছেন ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তুরস্কের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী (২০০৯-১৪) আহমেদ দাভুতোগলু। তুরস্কের বৈশ্বিক জাগরণে ২০১০ সালে নেওয়া পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্ব অপরিসীম এবং এই নীতির মস্তিষ্ক মনে করা হয় তাকে।

দাভুতোগলুর সময়ে তুরস্কের বৈশ্বিক কূটনৈতিক ব্যাপ্তি নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকায়। ২০১২ সালে তিনি মিয়ানমারে তুরস্কের প্রথম দূতাবাস চালু করেন। এর মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালে গণতন্ত্রের পথে মিয়ানমারের যাত্রা ও রোহিঙ্গা ইস্যু—উভয় সুবিধা আদায় করেন।

২০১৩ সালে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে দাভুতোগলুর একাধিক সফর করেছেন। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এটি ছিল তুরস্কের নতুন পররাষ্ট্রনীতি। বৈশ্বিক মানবিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার দীর্ঘদিনের ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ ছিল তুরস্কের। তুর্কি বিশেষজ্ঞ ই ফুয়াত কেইম্যান ও অনুর জাকাক এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ‘মানবিক রাষ্ট্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। দাভুতোগলুর নতুন পররাষ্ট্রনীতিতে সেই ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা’র প্রতিফলন উঠে আসে।

তুরস্কের মানবিকতার প্রতি এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছেন সাংবাদিক ও সাবেক সোমালি পরিকল্পনামন্ত্রী আবদিরহমান আলি। তিনি তুরস্কের মানবিক সহযোগিতা পদ্ধতিতে পশ্চিমা ও চীনা ত্রাণ সহযোগিতা মডেলের মাঝামাঝি বলে চিহ্নিত করেছেন। পশ্চিমা ও চীনের ত্রাণ সহযোগিতা কঠিন শর্তযুক্ত, আমলাতান্ত্রিক ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট। যা শেষ পর্যন্ত দুর্নীতি ও স্বৈরাচার শাসকদের হাতে গিয়ে পড়ে। বিপরীতে আলীর দাবি, তুরস্ক এক্ষেত্রে ‘‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পরিহার করে মানবাধিকার রক্ষা ও দুর্বলকে সহযোগিতা করার ‘নৈতিক’ অবস্থানকে গুরুত্ব দেয়।”

গত পাঁচ বছরে তুরস্ক নিজেদের এই ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ বাস্তবায়নে সহযোগিতার পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি এনজিও ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিশ্বে মানবিক সহায়তাকারী দেশের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তুরস্ক। এই খাতে দেশটি ব্যয় করেছে ৬ বিলিয়ন ডলার। শীর্ষ সহযোগিতাকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সহযোগিতায় ব্যয় করেছে ৬.৩ বিলিয়ন।

মুসলমানদের অধিকারের রক্ষায় সরব
রোহিঙ্গা ইস্যুতে এরদোয়ানের উচ্চকিত কণ্ঠের আরেকটি কারণ হচ্ছে, তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। সত্যিকার অর্থে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এরদোয়ানের প্রকাশ্য বক্তব্য অনেকটাই নিজের স্বার্থে। বিশ্বের যেকোনও স্থানের মুসলমানদের জন্য শক্তিশালী তুরস্কের ভাবমূর্তি দেশটির রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তুরস্কের নেতা হিসেবে এরদোয়ানের ১৫ বছরের শাসনামলে একসময় কোণঠাসা হয়ে পড়া মুসলমানরা মিডিয়া, বাণিজ্য ও রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

মুসলিম বিশ্বের বিরাট অংশের জনগণের মতের কথা বাদ দিলেও তুরস্কের অতি-উৎসাহী সমর্থকদের কাছে যেকোনও মুসলমানের অধিকারের জন্য এরদোয়ান প্রধান ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

এরদোয়ান দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও গবেষণায় বিভিন্ন সংকটের মুহূর্তে নিজেরে এই ভাবমূর্তি গড়ে তোলেছেন। যেমন—২০১১-১২ সালে মিসরে মুরসি শাসনামল বা ফিলিস্তিন। ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ প্রকাশ্য অবস্থান নেওয়ার কারণে আরবি দৈনিক পত্রিকার ফিলিস্তিনপন্থী কলাম লেখকদের কাছে এরদোয়ান ‘নয়া নাসের’ হিসেবে পরিচিত পেয়েছেন।



No comments: