প্রবল ভূমিকম্প ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। যেকোনো মুহূর্তে দুলে উঠতে পারে ভূপৃষ্ঠ। আর এর নেপথ্যে রয়েছে তিনটি টেকটোনিক প্লেট। ইন্ডিয়ান ও বার্মিজ মাইক্রোপ্লেটের মাঝখানে অবস্থান দেশটির। এ ছাড়া ইন্ডিয়ান প্লেটের পাশেই রয়েছে ইউরেশিয়ান টেকটোনিক প্লেট। ভূতত্ত্ববিদদের অভিমতÑ ইন্ডিয়ান প্লেটটি উত্তর-পূর্ব দিকে বছরে ৬
সেন্টিমিটার সরে যাচ্ছে এবং একই সাথে এ প্লেটটি ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে বছরে ৪৫ মিলিমিটার করে ঢুকে যাচ্ছে। অন্য দিকে বার্মিজ প্লেটটি বছরে ৩৫ মিলিমিটার করে উত্তর ও পূর্ব দিকে সরে যাচ্ছে। এ তিনটি প্লেটের অনবরত নড়াচড়ায় ফল্টগুলোকে অধিক সক্রিয় করছে। আঞ্চলিকভাবে সক্রিয় এ ফল্টগুলো বাংলাদেশ ও এর সীমানার বাইরে মাঝারি থেকে বড় ভূমিকম্পের সৃষ্টি করতে পারে বলে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন। এ দিকে গত কয়েক দিনে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, জাপান, ইকুয়েডরসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ভূমিকম্প ও সুনামির সতর্ক বার্তার কারণে সর্বমহলে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষত বাংলাদেশের মানুষ যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে এই আশঙ্কায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী এ প্রসঙ্গে বলেন, হিমালয় ভূকম্পন বলয়ে উত্থানপ্রক্রিয়া এখনো সক্রিয়। এ কারণে বাংলাদেশ ভূকম্পন এলাকা হিসেবে গণ্য। ঢাকা মহানগর ও আশপাশ এলাকার ভূমির গঠন অস্থিতিশীল ও ভূ-আলোড়নজনিত। এ মহানগরের পাশেই রয়েছে বেশ কয়েকটি অস্থিতিশীল ভূতাত্ত্বিক অঞ্চল। রয়েছে বেশ কিছু ফল্ট। এ ফল্টগুলো থেকেই হতে পারে ভূমিকম্প। ড. আনসারী জানিয়েছেন, ভূমিকম্প হতে পারে কিন্তু কখন হবে এর পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব নয়। আমরা জনসাধারণকে সচেতন হতে বলি। বাড়ি নির্মাণের সময় ভূমিকম্পের বিষয়টি মনে রাখার জন্য বলি। আমরা বলি শক্ত ও মজবুত ভবন নির্মাণ করার জন্য। আতঙ্কিত না হয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ভবনগুলো মজবুত করা অথবা মজবুত করতে না পারলেও ভেঙে নতুন করে তৈরি করতে হবে। এতে ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস পাবে।
বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিদ ড. হুমায়ুন আখতারের মতে, বঙ্গীয় ব-দ্বীপে প্রচুর শক্তি সঞ্চয় হচ্ছে। এই শক্তি এক সময় নির্গত হতে পারে। যুমনা থেকে মেঘনা পর্যন্ত এলাকা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষত ঢাকা অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ঢাকা থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে মানিকগঞ্জে যে ফল্ট রয়েছে এর সাথে মধুপুর ফল্টের সংযোগ আছে। এখান থেকেও যেকোনো সময় হতে পারে ভূমিকম্প।
অনেক চ্যুতি (ফল্ট) রয়েছে বাংলাদেশের মধ্যে ও এর সাথে লাগোয়া বেশ কিছু অঞ্চলে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মধুপুর ফল্ট অন্যতম। এটা উত্তর-দক্ষিণে ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ মধুপুর ও যমুনা প্লাবন অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত। দক্ষিণের সুরমা বেসিনের মধ্যে অবস্থিত ৩০০ কিলোমিটার আসাম-সিলেট ফল্ট। এটা উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী একটি ফল্ট। চট্টগ্রাম-মিয়ানমার উপকূলজুড়ে সমান্তরালভাবে চলে গেছে ৮০ কিলোমিটার লম্বা চট্টগ্রাম-মিয়ানমার প্লেট বাউন্ডারি ফল্ট। মেঘালয়-বাংলাদেশ সীমান্তজুড়ে অবস্থিত ডাউকি ফল্ট। এটা পূর্ব-পশ্চিমমুখী শিলং মালভূমির একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত।
অতীতে বাংলাদেশে প্লেট বাউন্ডারি ও ফল্টের কাছাকাছি বড় ভূমিকম্প হলেও নিকট অতীতে বেশ কিছু স্থানে মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার ইতিহাস রয়েছে। ১৯৯৭ সালের ৮ মে ৫ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল সিলেটে। এ ভূমিকম্পে সিলেটের বিভিন্ন ভবনে ফাটল দেখা দেয়। ১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল বান্দরবানে। সেখানে সেদিন ২০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ১৯৯৯ সালের ২২ জুলাই ৫ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয় কক্সবাজারের মহেশখালীতে। এ ভূমিকম্পে মহেশখালীর মাটির ঘর ধসে ছয়জনের মৃত্যু হয়। ২০০৩ সালের ২২ জুলাই রাঙ্গামাটির বরকলে আরেকটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হয়। সেখানে দুইজনের মৃত্যু হয় এবং বিভিন্ন ভবনে ফাটল দেখা দেয়। সেদিন সাগর বেশ উত্তাল হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ ভূমিকম্পঝুঁকিতে থাকলেও ভবিষ্যতের ক্ষতি মোকাবেলায় তেমন প্রস্তুতি নেই। বাংলাদেশ ঝড় ও বন্যাপ্রবণ অঞ্চল হওয়ায় এ দুটো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি দেশটির রয়েছে। এ দু’টি দুর্যোগ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সুনামও আছে, কিন্তু ভূমিকম্পের ক্ষতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। প্রবল শক্তিসম্পন্ন ভূমিকম্প হলে ভেঙে পড়তে পারে দুর্বল ভবন। মানুষ ভবনের নিচে চাপা পড়তে পারে, আটকে যেতে পারে। সাভারের রানা প্লাজার মতো একটি ভবন ধসে গেলে ভবনের মধ্যে আটকে পড়াদের উদ্ধারপ্রক্রিয়া থেকেই অনুমান করা যায় ভূমিকম্পের ক্ষতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ কত দুর্বল অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আবদুর রহমান। তিনি বলেন, রানা প্লাজার উদ্ধার তৎপরতা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করতেই লেগেছে এক সপ্তাহের বেশি। আবদুর রহমান মনে করেন, সরকারের উচিত ভূমিকম্পকে প্রাধান্য দিয়ে উদ্ধার করার সরঞ্জাম সংগ্রহ করা। ভূমিকম্প না হলেও এ যন্ত্রগুলো অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে। তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন ভবন নির্মাণে ছাড়পত্র দেয়ার আগে প্রতিটি ভবন ভূমিকম্প সহনীয় কি না তা পরীক্ষা করে দেখা। এ ক্ষেত্রে সরকারের মনিটরিং বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। কেননা টাকা হলেই যেকেউ যেকোনো ভবন নির্মাণ করতে পারছে। আর একটু বড় ভূমিকম্প হলে ঢাকা হতে পারে ধ্বংসস্তূপ ও বিলুপ্ত শহর।
Source:
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/111001#sthash.jm7nWrli.dpuf
No comments:
Post a Comment