অধ্যায়-৬
মাহমুদ তেলআবিব শহরের মিউনিসিপ্যাল মানচিত্র সামনে নিয়ে গভীরভাবে ভাবছিল।
সুরক্ষিত সিনবেথের অফিস। দক্ষিণ-উত্তর বিলম্বিত হারজেল এভিনিউ থেকে একটা সরু রাস্তা এগিয়ে গেছে পশ্চিমে। এ পথ ধরে শ’ দুয়েক গজ এগুলেই নাম-সাইনবোর্ডহীন সিনবেথ অফিসের কারাগার সদৃশ্য প্রধান ফটকে পৌঁছা যায়। সরু
মাহমুদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছিল। ভেবে পাচ্ছিল না সে এমিলিয়াকে উদ্ধারের পথ কি! রীতিমত যুদ্ধ ছাড়া সিনবেথ অফিসে ঢোকা এবং বের হওয়া অসম্ভব।
অন্য কোন পথ? অন্য পথ আর কি, হেলিকপ্টার নিয়ে সিনবেথ অফিসে গিয়ে হাজির হওয়া।
মাটির তলের কথা মনে হতেই বহুদিন আগে পড়া একটা নিইজের কথা তার মনে পড়ল। চাঞ্চল্যকর খবরটি ছিল দু’টি লাশ নিয়ে। বর্ষাকালে হারজেল এভিনিই-এর ড্রেন পরিষ্কার করার সময় দু’টি লাশ পাওয়া যায়। লাশ দু’টির ফটো বেরোয় পত্রিকায়। অকথ্য শারিরীক নির্যাতনের চিহ্ন ছিল তাদের শরীরে। খবরের কাগজের অনুসন্ধান রিপোর্টে বলা হয়েছিল, দু’সপ্তাহ আগে সিনবেথ লোক দু’টিকে গ্রেপ্তার করে।
সিনবেথের নির্যাতনেই তারা মারা যায়। মারা যাবার পর তাদের লাশ ড্রেনে ফেলে দেয়। খবরে উল্লেখ করা হয়, এভাবে লোক হত্যা করে সিনবেথের ভুগর্ভস্থ টর্চার চেম্বার সংলগ্ন ড্রেনে লাশ ফেলে দেয়া সিনবেথের একটা পুরোনো অভ্যাস।
খবরটি মনে পড়ার সাথে সাথে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মাহমুদের। মিউনিসিপ্যাল মানচিত্রের উপর আবার সে ঝুঁকে পড়ল।
মানচিত্রে হেড ড্রেনগুলোকে কালো এবং শাখা ও প্রশাখা ড্রেনগুলোকে নীল ও সবুজ লাইন দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। সে লক্ষ্য করল, একটি গভীর কালো রেখা হারজেল রোডের পশ্চিম পাশ দিয়ে সমান্তরালভাবে এগিয়ে গেছে। সে মেপে দেখল, হেড ড্রেনটি সিনবেথ অফিস ক্রস করে এগিয়ে গেছে। তার চোখ দু’টি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সিনবেথের ভূগর্ভস্থ টর্চার চেম্বারের সাথে তাহলে এই ড্রেনেরই একটা সংযোগ রয়েছে।
মাহমুদ নতুন এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তা করল। ভাবল, এই ড্রেনের পথ ধরে সিনবেথের টর্চার চেম্বারে পৌঁছা যায় কি না। গভীর চিন্তায় কপালটা তার কুঞ্চিত হলো, চোখ দু’টিও বন্ধ হয়ে এল।
একটু পরে উঠে গিয়ে লাইব্রেরী থেকে তেলআবিব শহরের ‘ওয়াটার এন্ড সুয়ারেজ’ ডায়াগ্রাম নিয়ে এল সে। ‘সুয়ারেজ ডায়াগ্রামটা’ বিস্তারিত। এতে ড্রেনগুলোর আয়তন এবং ম্যানহোলগুলোর অবয়বই সুন্দরভাবে চিহ্নিত আছে। মাহমুদ
রাস্তাটির দু’ধারের বিল্ডিংগুলো নিয়ে আধা সামরিক সিকুউরিটি
মিলিশিয়াদের গেরিলা ইউনিটের অফিস। এছাড়া সিনবেথ অফিসের চার দিক ঘিরে
মিনিষ্ট্রি অব হোমের নানা বিভাগের অফিস যাকে ডবল প্রটেকটেড এলাকা হিসেবে
গণ্য করা হয়।সুরক্ষিত সিনবেথের অফিস। দক্ষিণ-উত্তর বিলম্বিত হারজেল এভিনিউ থেকে একটা সরু রাস্তা এগিয়ে গেছে পশ্চিমে। এ পথ ধরে শ’ দুয়েক গজ এগুলেই নাম-সাইনবোর্ডহীন সিনবেথ অফিসের কারাগার সদৃশ্য প্রধান ফটকে পৌঁছা যায়। সরু
মাহমুদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছিল। ভেবে পাচ্ছিল না সে এমিলিয়াকে উদ্ধারের পথ কি! রীতিমত যুদ্ধ ছাড়া সিনবেথ অফিসে ঢোকা এবং বের হওয়া অসম্ভব।
অন্য কোন পথ? অন্য পথ আর কি, হেলিকপ্টার নিয়ে সিনবেথ অফিসে গিয়ে হাজির হওয়া।
মাটির তলের কথা মনে হতেই বহুদিন আগে পড়া একটা নিইজের কথা তার মনে পড়ল। চাঞ্চল্যকর খবরটি ছিল দু’টি লাশ নিয়ে। বর্ষাকালে হারজেল এভিনিই-এর ড্রেন পরিষ্কার করার সময় দু’টি লাশ পাওয়া যায়। লাশ দু’টির ফটো বেরোয় পত্রিকায়। অকথ্য শারিরীক নির্যাতনের চিহ্ন ছিল তাদের শরীরে। খবরের কাগজের অনুসন্ধান রিপোর্টে বলা হয়েছিল, দু’সপ্তাহ আগে সিনবেথ লোক দু’টিকে গ্রেপ্তার করে।
সিনবেথের নির্যাতনেই তারা মারা যায়। মারা যাবার পর তাদের লাশ ড্রেনে ফেলে দেয়। খবরে উল্লেখ করা হয়, এভাবে লোক হত্যা করে সিনবেথের ভুগর্ভস্থ টর্চার চেম্বার সংলগ্ন ড্রেনে লাশ ফেলে দেয়া সিনবেথের একটা পুরোনো অভ্যাস।
খবরটি মনে পড়ার সাথে সাথে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মাহমুদের। মিউনিসিপ্যাল মানচিত্রের উপর আবার সে ঝুঁকে পড়ল।
মানচিত্রে হেড ড্রেনগুলোকে কালো এবং শাখা ও প্রশাখা ড্রেনগুলোকে নীল ও সবুজ লাইন দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। সে লক্ষ্য করল, একটি গভীর কালো রেখা হারজেল রোডের পশ্চিম পাশ দিয়ে সমান্তরালভাবে এগিয়ে গেছে। সে মেপে দেখল, হেড ড্রেনটি সিনবেথ অফিস ক্রস করে এগিয়ে গেছে। তার চোখ দু’টি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সিনবেথের ভূগর্ভস্থ টর্চার চেম্বারের সাথে তাহলে এই ড্রেনেরই একটা সংযোগ রয়েছে।
মাহমুদ নতুন এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তা করল। ভাবল, এই ড্রেনের পথ ধরে সিনবেথের টর্চার চেম্বারে পৌঁছা যায় কি না। গভীর চিন্তায় কপালটা তার কুঞ্চিত হলো, চোখ দু’টিও বন্ধ হয়ে এল।
একটু পরে উঠে গিয়ে লাইব্রেরী থেকে তেলআবিব শহরের ‘ওয়াটার এন্ড সুয়ারেজ’ ডায়াগ্রাম নিয়ে এল সে। ‘সুয়ারেজ ডায়াগ্রামটা’ বিস্তারিত। এতে ড্রেনগুলোর আয়তন এবং ম্যানহোলগুলোর অবয়বই সুন্দরভাবে চিহ্নিত আছে। মাহমুদ
দেখল, সিনবেথ অফিসের কাছাকাছি সবচেয়ে সুবিধাজনক হল ডেভিড পার্কের ম্যানহোলটা। পার্কের বহির্দেয়ালের প্রায় গজ পাচেক ভেতরে বিরাট জলপাই গাছের তলে এই ম্যানহোল। আশে-পাশে আরও ঝাও গাছ আছে, ফুল গাছ আছে। একেবারে নির্জন জায়গা। পার্কের প্রহরীদের উপর নজর রাখতে পারলে এ ম্যানহোল নিরাপদেই ব্যবহার করা যায়।
এরপর মাহমুদ ‘ডেভেলপমেন্ট অব সুয়ারেজ সিস্টেম’ বইটা এনে তার উপর চোখ বুলাল। তেলআবিব লন্ডন নগরীর সুয়ারেজ সিস্টেমকেই অনুসরণ করেছে। এ সিস্টেম অনুসারে প্রশাখা ড্রেনগুলো ছাড়া হেড ও শাখা ড্রেনগুলোতে ড্রেন-বলয়ের দু’পাশে করিডোর থাকে। দু’করিডোরের মাঝখানে নালা দিয়ে বয়ে যায় ময়লার প্রবাহ। ড্রেনগুলোর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কার সুবিধার জন্যেই এই ব্যবস্থা। হেড ড্রেনগুলোর করিডোর দিয়ে খুব স্বচ্ছন্দেই মানুষ হেটে বেড়াতে পারে।
ওয়াটার সুয়ারেজ ডায়াগ্রাম হাতে নিয়েই মাহমুদ লাইব্রেরী রুম থেকে বেরিয়ে অফিসে এসে বসল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সন্ধ্যা ৬ টা।
টেলিফোন তুলে মাহমুদ আসলামকে বলল, শেখ জামালকে তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দাও।
মুহূর্ত কয়েক পরে শেখ জামাল এসে ঘরে ঢুকল। মাহমুদ তাকে বসতে ইঙ্গিত করে বলল, হারজেল এভিনিউ-এর সমান্তরালে বয়ে চলা ২নং হেড ড্রেন সিনবেথ অফিসকে ক্রস করেছে। আমরা এই ড্রেনের পথেই সিনবেথ হেড কোয়ার্টার প্রবেশ করব।
থামল মাহমুদ। চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল শেখ জামালের।
মাহমুদই আবার কথা বলল। বলল যে, আমরা যদি ডেভিড পার্কের নির্জন কোণের ম্যানহোলটি ব্যবহার করি, তাহলে আধা মাইল গিয়েই আমরা পাব ‘সিনবেথ হেড কোয়ার্টার।
একটু থামল মাহমুদ। তারপর বলল, সব কিছু ঠিক ঠাক করগে। আমরা রাত ৯ টায় প্রবেশ করব ২ নং হেড ড্রেনে। আসলাম ও যায়েদ রিয়ার গার্ড হিসেবে ডেভিড পার্কের ঐ ম্যানহোল পাহারায় থাকবে। আর জন দশ বারো জন লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখবে পার্কের আশে-পাশে। রাত দশটায় আমাদের পরিবহন ইউনিটের সালেম ও সুলাইমান দু’টো গাড়ী নিয়ে ডেভিড পার্কে যাবে।
মাহমুদ চুপ করল।
শেখ জামাল সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
শেখ জামাল বেরিয়ে গেলে মাহমুদ আবার সেই সুয়ারেজ ডায়াগ্রাম নিয়ে বসল। সিনবেথ হেড কোয়ার্টারের অবস্থান থেকে ডেভিড পার্কের ম্যানহোল পর্যন্ত দুরত্ব সে কম্পাস দিয়ে মাপল। মোট দুরত্ব হল এগার শ’ চল্লিশ গজ। মাহমুদ টেলিফোনে আসলামকে জিজ্ঞেস করল, সর্বোচ্চ কত বড় টেপ আমাদের আছে আসলাম? আসলাম বলল, ১৭৬০ গজ।
মাহমুদের মুখ প্রসন্ন হয়ে উঠল। বলল, ঠিক আছে।
বিভিন্ন সরঞ্জাম ভর্তি ব্যাগ গলায় ঝুলিয়ে
গ্যাসমাস্ক পরে দড়ির মই বেয়ে ম্যানহোল দিয়ে প্রথম নামল মাহমুদ। অনেক ভেবে
চিন্তে মাহমুদ বাম অর্থাৎ ড্রেনের পূর্বধারের করিডোরে নামারই সিদ্ধান্ত
নিয়েছে। হারজেল এভিনিউ থেকে সিনবেথ অফিস এবং ড্রেনের দুরত্বের হিসেবে
সিনবেথ অফিস ড্রেনের পূর্বধারেই পড়বে।
টর্চ জ্বেলে পূর্বপাশের করিডোরটা দেখে দড়ির মই থেকে করিডোরে পা রাখল মাহমুদ। টর্চের আলোতে কয়েকটা বড় ধরনের ইদুর ও মাকড়সা ছুটে পালাল। মাকড়সাগুলোর বিপুল বপু দেখে আঁৎকে উঠল সে। রক্তপায়ী মাকড়সার কথা মহমুদ পড়েছে, কিন্তু তারাতো ফিলিস্তিনে থাকে না।
মাহমুদ নামার পর শেখ জামালও নেমে এল দড়ির মই বেয়ে।
শেখ জামাল নেমে আসার পর দড়ির মই-এর সাথে টেপের এক মাথাকে বেধে দিল মাহমুদ। ১৭৬০ গজ দীর্ঘ টেপ থেকে সে ১১শ’ ৪০ গজ কেটে নিয়ে এসেছে যাতে করে ড্রেনে নেমে সিনবেথ অফিসের লোকেশন নিয়ে মাথা ঘামাতে না হয়। টেপ যেখানে গিয়ে শেষ হবে সেটাই হবে মোটামুটিভাবে সিনবেথ অফিসের লোকেশন।
টর্চ জ্বেলে তারা দক্ষিণ দিকে চলতে শুরু করল। হাতঘড়ির সাথে ফিট করা দিক নির্দেশক কম্পাসের দিকে চেয়ে দেখল তারা ঠিক দক্ষিণ দিকেই চলছে।
মাহমুদ আগে চলছে। শেখ জামাল তার পিছনে। টর্চের আলো এবং সেই সাথে মানুষের পদশব্দে নানা ধরনের পোকা মাকড় ছুটে পালিয়ে তাদের পথ করে দিচ্ছে। করিডোরের অল্প নীচ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে নর্দমা।
‘সাপ সাপ’ বলে চিৎকার করে উঠে শেখ জামাল প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাহমুদের গায়ের উপর। টর্চ পিছনে ফিরিয়ে মাহমুদ দেখল, প্রায় ৫ গজ একটি উদ্যতফণা সাপ ছুটে আসতে আসতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।
মাহমুদ সাইলেন্সার লাগানো রিভলভারটা তুলে ধীরে সুস্থে একটা গুলী করল। সাপটি ঝপ করে পড়ে গেল নর্দমায়।
মাহমুদ শেখ জামালকে বলল, তুমি টর্চ জ্বালিয়ে পিছনে ফিরে ধীরে ধীরে এস। তুমি পিছনটা দেখবে, আমি সামনে।
ধীরে ধীরে চলছিল তারা। হঠাৎ টেপে টান পড়ায় থামল থমকে দাড়াল মাহমুদ। বুকে ঝুলানো ব্যাগে হাত দিয়ে দেখল টেপ শেষ। তাহলে কি তারা সিনবেথের লোকেশনে পৌঁছে গেছে? ঘড়ির দিকে তাকাল মাহমুদ। দেখল ৯টা ৪০ মিনিট। ৪০ মিনিট লেগেছে তাদের ১১শ’ গজ আসতে।
মাহমুদ বলল, শেখ জামাল আমরা এসে গেছি।
তারপর মাহমুদ ড্রেনের দেয়ালের দিকে ঘুরে দাড়াল। রবারের গ্লাভস খুলে হাত রাখল ড্রেনের দেয়ালে। কংক্রিটের শক্ত দেয়াল। টর্চের আলো ফেলে দেখল সিমেন্ট ঢালাই করে তৈরী, একদম সলিড। কোথাও অস্বাভাবিক কোন চিহ্ন নেই।
টেপের মাথা শেখ জামালের হাতে দিয়ে মাহমুদ বলল, তুমি এখানে দাড়াও, আমি সামনে খুঁজে দেখি। কংক্রিট কিংবা ইস্পাতের কোন দরজা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
মাহমুদ টর্চ জ্বেলে ড্রেনের দেয়াল পরীক্ষা করতে করতে সমানে এগুলো। প্লাষ্টিকের বাটওয়ালা লোহার হাতুড়ি দিয়ে প্রায় ১ ফুট অন্তর অন্তর ড্রেনের দেয়ালে ঘা দিচ্ছিল মাহমুদ, ফাঁপা বা ব্যতিক্রমধর্মী কোন শব্দ কানে আসে কি না তা দেখার জন্যে। এভাবে প্রায় সে চল্লিশ গজ সামনে এগুলো, না কোন চিহ্ন কোথাও সে পেল না। আবার ফিরে এল মাহমুদ ঐভাবে পরীক্ষা করতে করতেই।
শেখ জামালের কাছ ফিরে আসার পর মাহমুদ সামনের মত পিছনের দিকটাও পরীক্ষা করতে এগিয়ে গেল। হতে পারে সিনবেথের অফিস তারা পিছনে ফেলে এসেছে। মাহমুদ যেমন সামনের দিকটা দেখেছে তেমনি পিছনের ৪০ গজ পরিমাণ দেয়ালও সে ঐভাবে পরীক্ষা করল। না, ইস্পাতের সলিড দেয়ালে কোথাও সামান্য পরিমাণ অস্বাভাবিকতারও চিহ্ন নেই।
ফিরে এল মাহমুদ আবার শেখ জামালের কাছে। তারা গা দিয়ে ঘাম ঝরছিল, কিন্তু তারা ছেয়েও উদ্বিগ্ন তার মনটা। তাহলে তারা কি ব্যর্থ হবে? মাপ অনুসারে তারা তো সিনবেথের অবস্থানেই পৌছেছে। না সিনবেথের দরজাটা ওপার করিডোরে? মনের এ চিন্তাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হল মাহমুদের কাছে। শেখ জামালকে সে বলল, তুমি এখানে দাঁড়াও আমি ওপারের দেয়ালটা পরীহ্মা করে আসি।
জামাল বলল, জনাব অনুমতি দিলে আমি দেখে আসি।
মাহমুদ হেসে বলল, না জামাল আমাকেই যেতে হবে।
বলে মাহমুদ বুকের ব্যাগ থেকে রবারের ডুবুরী পোশাক বের করে নিল। তারপর ওটা পরে নিয়ে নেমে গেল সে নর্দমায়। সাঁতরে ওপারে পার হয়ে গেল মাহমুদ।
ওপারের করিডোরে উঠে ডুবুরীর পোশাক পরেই সেই দেয়াল পরীক্ষার পালা সে শুরু করল। শেখ জামালের অবস্থানকে মাঝখানে রেখে, সামনে চল্লিশ গজ সে পরীক্ষা করল। না, সে একই দৃশ্য, সলিড কংক্রিটের দেয়াল, কোথাও কোন অস্বাভাবিকতার চিহ্নই নেই।
হতাশা এবং ক্লান্তিতে মাহমুদ ড্রেনের করিডোরে বসে পড়ে। তাহলে তারা কি দিক ভুল করেছে? না দিক ভুল হয়নি। চলার সময় ২ নং মূল হেড ড্রেন থেকে এর অন্য কোন শাখায় তো তারা ঢুকে পড়েনি? না সে ভুল তারা করেনি। তারা মোট দশটি শাখা ড্রেন পাশ কাটিয়ে মূল হেড ড্রেন ধরেই এগিয়ে এসেছে।
হঠাৎ তার মনে হল, টেপতো তাদের মিস গাইড করছে না? টেপের মাপ এবং ডেভিড পার্ক থেকে সিনবেথ হেড কোয়ার্টার পর্যন্ত যে মাপ সে সুয়ারেজ ডায়াগ্রাম থেকে নিয়েছে তা কি নিখুঁত? ডায়াগ্রামে ড্রেনের জিগ -জ্যাগকে তার কাছে তো তখন বড় বলে মনে হয়নি, কিন্তু বাস্তবে তো এই জিগ-জ্যাগ দুরত্বের ক্ষেত্রে অনেক পার্থক্য সৃষ্টি করে! মেপে দেখার সময় মাহমুদের এ কথাটা মোটেই মনে হয়নি। এই ভুলের জন্যে নিজের চুল নিজেই ছিড়তে ইচ্ছা করল মাহমুদের। কিন্তু পরক্ষণেই সচেতন হল, এ সময় অধৈর্য হলে চলবে না, সাহস হারালে চলবে না।
মাহমুদ চিন্তা করে দেখল, তার হিসেব ভুল হবার অর্থ হলো ড্রেনে প্রকৃত দৈর্ঘের চেয়ে টেপের মাপ কম হওয়া। অর্থাৎ তাদের আরও সামনে এগুতে হবে।
মাহমুদ নর্দমা পার হয়ে শেখ জামালের কাছে ফিরে এল। বলল, শেখ জামাল আমাদের আরও সামনে এগুতে হবে। শেখ জামাল বলল, চলুন জনাব, ইনশাআল্লাহ আমাদের লক্ষ্য আমরা খুঁজে পাবই।
-ইনশায়াল্লাহ’ বলে মাহমুদ সামনে পা বাড়াল।
মাহমুদ এবার পাশের দেয়ালসহ চারিদিকটা ভালভাবে পরীক্ষা করেই ধীরে ধীরে সামনে এগুতে লাগল। টেপের সাথে দু’শ গজের একটা প্লাষ্টিক কর্ড বেধে তারা সামনে এগুতে লাগল।
করিডোর এবং দেয়ালের উপর টর্চের আলো ফেলে এবং হাতুড়ি দিয়ে কংক্রিটের দেয়াল ঠুকে ঠুকে সে সামনে এগুচ্ছিল। হঠাৎ এক জায়গায় করিডোরের উপর কয়েক খন্ড ইলেকট্রিকের লালরঙা তার টর্চের আলোর চিক চিক করে উঠল। মাহমুদের চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঝুকে পড়ে তার তুলতে গিয়ে সিগারেটের একটা খন্ডও তার চোখে পড়ল। সিগারেটের খন্ডটাও সে তুলে নিল। সিগারেটের ফিল্টার দেখেই বুঝল, অত্যন্ত দামী সিগারেট। ইলেকট্রিকের তার এবং সিগারেটের খন্ডের উপর জমে ওঠা ময়লার পরিমাণ থেকে মাহমুদ বুঝল, এ দুটো জিনিষই খুব আগের নয়।
মাহমুদ বলল, শেখ জামাল আল্লাহ বোধ হয় আমাদের দয়া করেছেন। আমরা বোধ হয় মনজিলে পৌঁছে গেছি।
হঠাৎ মাথা বরাবর দেয়ালের গায়ে বর্গাকৃতি কাল একটি বর্ডার তার নজরে পড়ল। হাত দিতে গিয়েও চমকে টেনে নিল সে হাত। বুকে ঝুলানো ব্যাগ থেকে ডেটোনেটর বের করে কালো বর্ডারের মাঝখানের দেয়াল স্পর্শ করে বুঝল, ওটা সিমেন্ট রং-এর ইলেকট্রিফায়েড ইস্পাত। চারধারটা কালো রাবারের বর্ডার।
ফিস্ ফিস্ করে মাহমুদ বলল, শেখ জামাল, এটাই সেই দরজা। দু’জনেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল।
কিভাবে এগুবে একটু চিন্তা করল মাহমুদ। যেহেতু বিদ্যুৎ সুইচটা ভেতরে তাই বিদ্যুতায়িত এই দরজা থেকে বিদ্যুৎ ডিসকানেক্ট করার কোন উপায় নেই। এখন একটিই পথ এবং তা হলো গোটা দরজা কেটে নামিয়ে আনা। কিন্তু ঘরের ভেতরটা নিরাপদ না করে দরজা কেটে নামানোর অর্থ শত্রুকে স্বাগত জানানো।
চিন্তা করছিল মাহমুদ। একটা রবারের নল ঢুকানো যাবে, এমন ফুটা কিভাবে ইস্পাতের এই দরজায় করা যায়? ল্যাসার বিম দিয়ে মুহূর্তে এটা করা সম্ভব। কিন্তু বিদ্যুতায়িত ইস্পাতে ল্যাসার প্রয়োগ করলে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এটা হলে তার আসল কাজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আরো ভাবল মাহমুদ। অবশেষে অনেক চিন্তা করে খুব সন্তর্পণে রবারের বর্ডার এবং কংক্রিটের দেয়ালের সংযোগ স্থলে ল্যাসার রস্মি প্রয়োগ করে আধা ইঞ্চি ব্যাসের একটা ফুটো করল। ফুটো দিয়ে একটা রাবারের নল ঢুকিয়ে দিল। বিনা বাধায় নলটি ফুটখানেক প্রবেশ করায় সে বুঝল নলটি নিশ্চয় ঘরে প্রবেশ করেছে। এরপর মাহমুদ সেই রাবারের নলের প্রান্ত ফ্লাইং ক্লোরোফরমের কনটেইনারের সাথে জুড়ে দিয়ে সুইচ অন করে দিল। এক মিনিট অন করে রাখার পর সুইচ অফ করে দিল মাহমুদ।
পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার পর মাহমুদ রাবারের বর্ডার বরাবর ইস্পাতের দরজার চারদিকে ল্যাসার বিম চালিয়ে দরজাটা কেটে ফেলল। সশব্দে ভারি দরজাটা পড়ে গেল করিডোরের ওপর। দরজার নীচের প্রান্তের সাথে একটা ইলেকট্রিকের তার যুক্ত ছিল, দরজার ভারে তার ছিড়ে গেল। বিদ্যুতায়নের উৎস ছিল ঐ তারটি। মাহমুদ তারটির মুখ টেপ দিয়ে মুড়ে দিল।
মাহমুদ মনে করেছিল ইস্পাতের দরজাটা খুললেই সিনবেথের ভূগর্ভস্থ কক্ষে প্রবেশ করা যাবে, কিন্তু তা হলো না। এ দরজার পরে চার পাচঁ গজ লম্বা একটা সুড়ঙ্গ, তারপর আরেকটা দরজা। সেটাও ইস্পাতের।
মাহমুদ শেখ জামালকে ড্রেনের করিডোরে অপেক্ষা করতে বলে সেই সুড়ঙ্গে উঠে গেল। ডেটোনেটর দিয়ে দেখল দ্বিতীয় এ দরজা বিদ্যুতায়িত নয়। তার সন্দেহ হলো, তার আগের ক্লোরোফরম এ দরজা ডিঙ্গিয়ে সরে যেতে পেরেছে কি না!
কোন সন্দেহের অবকাশ না রাখার জন্যে মাহমুদ দরজার গোড়ায় লেসার বিম দিয়ে ছোট্ট একটা ফুটো করে রাবারের নল দিয়ে ফ্লাইং ক্লোরোফরম আবার চালান করে দিল ঘরের ভেতরে। ঘরে যদি কেউ থাকে গন্ধহীন এ ক্লোরোফরম নিমিষে তাদের ঘুম পাড়িয়ে দেবে।
ক্লোরোফরম চালান দেবার পর দু’তিন মিনিট অপেক্ষা করল মাহমুদ। তারপর ল্যাসার বিম দিয়ে দরজার এক পাশে বড় ধরনের ফুটো করল। চোখ লাগাল সে ফুটোয়, দেখল উজ্জ্বল আলোয় ঘরটি ভরে আছে। ঘরে কেউ নেই। মনটা মাহমুদের ছ্যাঁৎ করে উঠল। তাহলে তার সব চেষ্টা বৃথা যবে।
হঠাৎ তার চোখ পড়ল ঘরের একপাশে মেঝের ওপর। ভালো করে দেখা যায় না। মনে হল, মেঝের ওপর একটা তক্তপোষ। সে তক্তপোষের ওপর মানুষের মত কিছু শুয়ে আছে, কাপড় দেখে বুঝা যায়। ওকি এমিলিয়া! দেহের রক্ত তার চঞ্চল হয়ে উঠল। বুকটা তোলপাড় করে উঠল তার।
মাহমুদ তাড়াতাড়ি ল্যাসার বিম দিয়ে দরজার দুপাশটা কেটে ফেলল। তারপর দরজা একপাশে সরিয়ে রেখে ছুটে গেল ঘরে তক্তপোষের কাছে। এক পলক এমিলিয়াকে দেখে পরীক্ষা করে ছুটে গেল সে বাইরের দরজায়। দরজাটা বন্ধই ছিল, লক করে দিল মাহমুদ। তারপর দৌড়ে গিয়ে সে বিদ্যুতায়নের সেই তারটা নিয়ে এল। প্লাকটি খুলে রেখে তারের মুখ থেকে টেপ খুলে নিয়ে সেটা সে জুড়ে দিল বাইরের দরজার সাথে। তারপর প্লাকটি আবার লাগিয়ে দিল। ডেটোনেটর দিয়ে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হল যে, দরজাটি বিদ্যুতায়িত হয়েছে। খুশী হল মাহমুদ।
এবার সে ছুটে এল এমিলিয়ার কাছে। আবার নাকে হাত দিয়ে দেখল সব ঠিক আছে।
তাড়াতাড়ি সে তার বাধনগুলো কেটে তাকে গ্যাসমাষ্ক পরিয়ে কাঁধে তুলে নিল।
তারপর সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে নেমে এল ড্রেনের করিডোরে।
ফিরতি যাত্রা শুরু হলো তাদের।
এক হাতে কাঁধে এমিলিয়াকে ধরে, অন্য হাতে টর্চ জ্বালিয়ে আগে আগে হাটছিল মাহমুদ। তার পিছনে শেখ জামাল, সেই আগের মত করে।
টর্চ জ্বেলে পূর্বপাশের করিডোরটা দেখে দড়ির মই থেকে করিডোরে পা রাখল মাহমুদ। টর্চের আলোতে কয়েকটা বড় ধরনের ইদুর ও মাকড়সা ছুটে পালাল। মাকড়সাগুলোর বিপুল বপু দেখে আঁৎকে উঠল সে। রক্তপায়ী মাকড়সার কথা মহমুদ পড়েছে, কিন্তু তারাতো ফিলিস্তিনে থাকে না।
মাহমুদ নামার পর শেখ জামালও নেমে এল দড়ির মই বেয়ে।
শেখ জামাল নেমে আসার পর দড়ির মই-এর সাথে টেপের এক মাথাকে বেধে দিল মাহমুদ। ১৭৬০ গজ দীর্ঘ টেপ থেকে সে ১১শ’ ৪০ গজ কেটে নিয়ে এসেছে যাতে করে ড্রেনে নেমে সিনবেথ অফিসের লোকেশন নিয়ে মাথা ঘামাতে না হয়। টেপ যেখানে গিয়ে শেষ হবে সেটাই হবে মোটামুটিভাবে সিনবেথ অফিসের লোকেশন।
টর্চ জ্বেলে তারা দক্ষিণ দিকে চলতে শুরু করল। হাতঘড়ির সাথে ফিট করা দিক নির্দেশক কম্পাসের দিকে চেয়ে দেখল তারা ঠিক দক্ষিণ দিকেই চলছে।
মাহমুদ আগে চলছে। শেখ জামাল তার পিছনে। টর্চের আলো এবং সেই সাথে মানুষের পদশব্দে নানা ধরনের পোকা মাকড় ছুটে পালিয়ে তাদের পথ করে দিচ্ছে। করিডোরের অল্প নীচ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে নর্দমা।
‘সাপ সাপ’ বলে চিৎকার করে উঠে শেখ জামাল প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাহমুদের গায়ের উপর। টর্চ পিছনে ফিরিয়ে মাহমুদ দেখল, প্রায় ৫ গজ একটি উদ্যতফণা সাপ ছুটে আসতে আসতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।
মাহমুদ সাইলেন্সার লাগানো রিভলভারটা তুলে ধীরে সুস্থে একটা গুলী করল। সাপটি ঝপ করে পড়ে গেল নর্দমায়।
মাহমুদ শেখ জামালকে বলল, তুমি টর্চ জ্বালিয়ে পিছনে ফিরে ধীরে ধীরে এস। তুমি পিছনটা দেখবে, আমি সামনে।
ধীরে ধীরে চলছিল তারা। হঠাৎ টেপে টান পড়ায় থামল থমকে দাড়াল মাহমুদ। বুকে ঝুলানো ব্যাগে হাত দিয়ে দেখল টেপ শেষ। তাহলে কি তারা সিনবেথের লোকেশনে পৌঁছে গেছে? ঘড়ির দিকে তাকাল মাহমুদ। দেখল ৯টা ৪০ মিনিট। ৪০ মিনিট লেগেছে তাদের ১১শ’ গজ আসতে।
মাহমুদ বলল, শেখ জামাল আমরা এসে গেছি।
তারপর মাহমুদ ড্রেনের দেয়ালের দিকে ঘুরে দাড়াল। রবারের গ্লাভস খুলে হাত রাখল ড্রেনের দেয়ালে। কংক্রিটের শক্ত দেয়াল। টর্চের আলো ফেলে দেখল সিমেন্ট ঢালাই করে তৈরী, একদম সলিড। কোথাও অস্বাভাবিক কোন চিহ্ন নেই।
টেপের মাথা শেখ জামালের হাতে দিয়ে মাহমুদ বলল, তুমি এখানে দাড়াও, আমি সামনে খুঁজে দেখি। কংক্রিট কিংবা ইস্পাতের কোন দরজা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
মাহমুদ টর্চ জ্বেলে ড্রেনের দেয়াল পরীক্ষা করতে করতে সমানে এগুলো। প্লাষ্টিকের বাটওয়ালা লোহার হাতুড়ি দিয়ে প্রায় ১ ফুট অন্তর অন্তর ড্রেনের দেয়ালে ঘা দিচ্ছিল মাহমুদ, ফাঁপা বা ব্যতিক্রমধর্মী কোন শব্দ কানে আসে কি না তা দেখার জন্যে। এভাবে প্রায় সে চল্লিশ গজ সামনে এগুলো, না কোন চিহ্ন কোথাও সে পেল না। আবার ফিরে এল মাহমুদ ঐভাবে পরীক্ষা করতে করতেই।
শেখ জামালের কাছ ফিরে আসার পর মাহমুদ সামনের মত পিছনের দিকটাও পরীক্ষা করতে এগিয়ে গেল। হতে পারে সিনবেথের অফিস তারা পিছনে ফেলে এসেছে। মাহমুদ যেমন সামনের দিকটা দেখেছে তেমনি পিছনের ৪০ গজ পরিমাণ দেয়ালও সে ঐভাবে পরীক্ষা করল। না, ইস্পাতের সলিড দেয়ালে কোথাও সামান্য পরিমাণ অস্বাভাবিকতারও চিহ্ন নেই।
ফিরে এল মাহমুদ আবার শেখ জামালের কাছে। তারা গা দিয়ে ঘাম ঝরছিল, কিন্তু তারা ছেয়েও উদ্বিগ্ন তার মনটা। তাহলে তারা কি ব্যর্থ হবে? মাপ অনুসারে তারা তো সিনবেথের অবস্থানেই পৌছেছে। না সিনবেথের দরজাটা ওপার করিডোরে? মনের এ চিন্তাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হল মাহমুদের কাছে। শেখ জামালকে সে বলল, তুমি এখানে দাঁড়াও আমি ওপারের দেয়ালটা পরীহ্মা করে আসি।
জামাল বলল, জনাব অনুমতি দিলে আমি দেখে আসি।
মাহমুদ হেসে বলল, না জামাল আমাকেই যেতে হবে।
বলে মাহমুদ বুকের ব্যাগ থেকে রবারের ডুবুরী পোশাক বের করে নিল। তারপর ওটা পরে নিয়ে নেমে গেল সে নর্দমায়। সাঁতরে ওপারে পার হয়ে গেল মাহমুদ।
ওপারের করিডোরে উঠে ডুবুরীর পোশাক পরেই সেই দেয়াল পরীক্ষার পালা সে শুরু করল। শেখ জামালের অবস্থানকে মাঝখানে রেখে, সামনে চল্লিশ গজ সে পরীক্ষা করল। না, সে একই দৃশ্য, সলিড কংক্রিটের দেয়াল, কোথাও কোন অস্বাভাবিকতার চিহ্নই নেই।
হতাশা এবং ক্লান্তিতে মাহমুদ ড্রেনের করিডোরে বসে পড়ে। তাহলে তারা কি দিক ভুল করেছে? না দিক ভুল হয়নি। চলার সময় ২ নং মূল হেড ড্রেন থেকে এর অন্য কোন শাখায় তো তারা ঢুকে পড়েনি? না সে ভুল তারা করেনি। তারা মোট দশটি শাখা ড্রেন পাশ কাটিয়ে মূল হেড ড্রেন ধরেই এগিয়ে এসেছে।
হঠাৎ তার মনে হল, টেপতো তাদের মিস গাইড করছে না? টেপের মাপ এবং ডেভিড পার্ক থেকে সিনবেথ হেড কোয়ার্টার পর্যন্ত যে মাপ সে সুয়ারেজ ডায়াগ্রাম থেকে নিয়েছে তা কি নিখুঁত? ডায়াগ্রামে ড্রেনের জিগ -জ্যাগকে তার কাছে তো তখন বড় বলে মনে হয়নি, কিন্তু বাস্তবে তো এই জিগ-জ্যাগ দুরত্বের ক্ষেত্রে অনেক পার্থক্য সৃষ্টি করে! মেপে দেখার সময় মাহমুদের এ কথাটা মোটেই মনে হয়নি। এই ভুলের জন্যে নিজের চুল নিজেই ছিড়তে ইচ্ছা করল মাহমুদের। কিন্তু পরক্ষণেই সচেতন হল, এ সময় অধৈর্য হলে চলবে না, সাহস হারালে চলবে না।
মাহমুদ চিন্তা করে দেখল, তার হিসেব ভুল হবার অর্থ হলো ড্রেনে প্রকৃত দৈর্ঘের চেয়ে টেপের মাপ কম হওয়া। অর্থাৎ তাদের আরও সামনে এগুতে হবে।
মাহমুদ নর্দমা পার হয়ে শেখ জামালের কাছে ফিরে এল। বলল, শেখ জামাল আমাদের আরও সামনে এগুতে হবে। শেখ জামাল বলল, চলুন জনাব, ইনশাআল্লাহ আমাদের লক্ষ্য আমরা খুঁজে পাবই।
-ইনশায়াল্লাহ’ বলে মাহমুদ সামনে পা বাড়াল।
মাহমুদ এবার পাশের দেয়ালসহ চারিদিকটা ভালভাবে পরীক্ষা করেই ধীরে ধীরে সামনে এগুতে লাগল। টেপের সাথে দু’শ গজের একটা প্লাষ্টিক কর্ড বেধে তারা সামনে এগুতে লাগল।
করিডোর এবং দেয়ালের উপর টর্চের আলো ফেলে এবং হাতুড়ি দিয়ে কংক্রিটের দেয়াল ঠুকে ঠুকে সে সামনে এগুচ্ছিল। হঠাৎ এক জায়গায় করিডোরের উপর কয়েক খন্ড ইলেকট্রিকের লালরঙা তার টর্চের আলোর চিক চিক করে উঠল। মাহমুদের চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঝুকে পড়ে তার তুলতে গিয়ে সিগারেটের একটা খন্ডও তার চোখে পড়ল। সিগারেটের খন্ডটাও সে তুলে নিল। সিগারেটের ফিল্টার দেখেই বুঝল, অত্যন্ত দামী সিগারেট। ইলেকট্রিকের তার এবং সিগারেটের খন্ডের উপর জমে ওঠা ময়লার পরিমাণ থেকে মাহমুদ বুঝল, এ দুটো জিনিষই খুব আগের নয়।
মাহমুদ বলল, শেখ জামাল আল্লাহ বোধ হয় আমাদের দয়া করেছেন। আমরা বোধ হয় মনজিলে পৌঁছে গেছি।
হঠাৎ মাথা বরাবর দেয়ালের গায়ে বর্গাকৃতি কাল একটি বর্ডার তার নজরে পড়ল। হাত দিতে গিয়েও চমকে টেনে নিল সে হাত। বুকে ঝুলানো ব্যাগ থেকে ডেটোনেটর বের করে কালো বর্ডারের মাঝখানের দেয়াল স্পর্শ করে বুঝল, ওটা সিমেন্ট রং-এর ইলেকট্রিফায়েড ইস্পাত। চারধারটা কালো রাবারের বর্ডার।
ফিস্ ফিস্ করে মাহমুদ বলল, শেখ জামাল, এটাই সেই দরজা। দু’জনেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল।
কিভাবে এগুবে একটু চিন্তা করল মাহমুদ। যেহেতু বিদ্যুৎ সুইচটা ভেতরে তাই বিদ্যুতায়িত এই দরজা থেকে বিদ্যুৎ ডিসকানেক্ট করার কোন উপায় নেই। এখন একটিই পথ এবং তা হলো গোটা দরজা কেটে নামিয়ে আনা। কিন্তু ঘরের ভেতরটা নিরাপদ না করে দরজা কেটে নামানোর অর্থ শত্রুকে স্বাগত জানানো।
চিন্তা করছিল মাহমুদ। একটা রবারের নল ঢুকানো যাবে, এমন ফুটা কিভাবে ইস্পাতের এই দরজায় করা যায়? ল্যাসার বিম দিয়ে মুহূর্তে এটা করা সম্ভব। কিন্তু বিদ্যুতায়িত ইস্পাতে ল্যাসার প্রয়োগ করলে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এটা হলে তার আসল কাজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আরো ভাবল মাহমুদ। অবশেষে অনেক চিন্তা করে খুব সন্তর্পণে রবারের বর্ডার এবং কংক্রিটের দেয়ালের সংযোগ স্থলে ল্যাসার রস্মি প্রয়োগ করে আধা ইঞ্চি ব্যাসের একটা ফুটো করল। ফুটো দিয়ে একটা রাবারের নল ঢুকিয়ে দিল। বিনা বাধায় নলটি ফুটখানেক প্রবেশ করায় সে বুঝল নলটি নিশ্চয় ঘরে প্রবেশ করেছে। এরপর মাহমুদ সেই রাবারের নলের প্রান্ত ফ্লাইং ক্লোরোফরমের কনটেইনারের সাথে জুড়ে দিয়ে সুইচ অন করে দিল। এক মিনিট অন করে রাখার পর সুইচ অফ করে দিল মাহমুদ।
পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার পর মাহমুদ রাবারের বর্ডার বরাবর ইস্পাতের দরজার চারদিকে ল্যাসার বিম চালিয়ে দরজাটা কেটে ফেলল। সশব্দে ভারি দরজাটা পড়ে গেল করিডোরের ওপর। দরজার নীচের প্রান্তের সাথে একটা ইলেকট্রিকের তার যুক্ত ছিল, দরজার ভারে তার ছিড়ে গেল। বিদ্যুতায়নের উৎস ছিল ঐ তারটি। মাহমুদ তারটির মুখ টেপ দিয়ে মুড়ে দিল।
মাহমুদ মনে করেছিল ইস্পাতের দরজাটা খুললেই সিনবেথের ভূগর্ভস্থ কক্ষে প্রবেশ করা যাবে, কিন্তু তা হলো না। এ দরজার পরে চার পাচঁ গজ লম্বা একটা সুড়ঙ্গ, তারপর আরেকটা দরজা। সেটাও ইস্পাতের।
মাহমুদ শেখ জামালকে ড্রেনের করিডোরে অপেক্ষা করতে বলে সেই সুড়ঙ্গে উঠে গেল। ডেটোনেটর দিয়ে দেখল দ্বিতীয় এ দরজা বিদ্যুতায়িত নয়। তার সন্দেহ হলো, তার আগের ক্লোরোফরম এ দরজা ডিঙ্গিয়ে সরে যেতে পেরেছে কি না!
কোন সন্দেহের অবকাশ না রাখার জন্যে মাহমুদ দরজার গোড়ায় লেসার বিম দিয়ে ছোট্ট একটা ফুটো করে রাবারের নল দিয়ে ফ্লাইং ক্লোরোফরম আবার চালান করে দিল ঘরের ভেতরে। ঘরে যদি কেউ থাকে গন্ধহীন এ ক্লোরোফরম নিমিষে তাদের ঘুম পাড়িয়ে দেবে।
ক্লোরোফরম চালান দেবার পর দু’তিন মিনিট অপেক্ষা করল মাহমুদ। তারপর ল্যাসার বিম দিয়ে দরজার এক পাশে বড় ধরনের ফুটো করল। চোখ লাগাল সে ফুটোয়, দেখল উজ্জ্বল আলোয় ঘরটি ভরে আছে। ঘরে কেউ নেই। মনটা মাহমুদের ছ্যাঁৎ করে উঠল। তাহলে তার সব চেষ্টা বৃথা যবে।
হঠাৎ তার চোখ পড়ল ঘরের একপাশে মেঝের ওপর। ভালো করে দেখা যায় না। মনে হল, মেঝের ওপর একটা তক্তপোষ। সে তক্তপোষের ওপর মানুষের মত কিছু শুয়ে আছে, কাপড় দেখে বুঝা যায়। ওকি এমিলিয়া! দেহের রক্ত তার চঞ্চল হয়ে উঠল। বুকটা তোলপাড় করে উঠল তার।
মাহমুদ তাড়াতাড়ি ল্যাসার বিম দিয়ে দরজার দুপাশটা কেটে ফেলল। তারপর দরজা একপাশে সরিয়ে রেখে ছুটে গেল ঘরে তক্তপোষের কাছে। এক পলক এমিলিয়াকে দেখে পরীক্ষা করে ছুটে গেল সে বাইরের দরজায়। দরজাটা বন্ধই ছিল, লক করে দিল মাহমুদ। তারপর দৌড়ে গিয়ে সে বিদ্যুতায়নের সেই তারটা নিয়ে এল। প্লাকটি খুলে রেখে তারের মুখ থেকে টেপ খুলে নিয়ে সেটা সে জুড়ে দিল বাইরের দরজার সাথে। তারপর প্লাকটি আবার লাগিয়ে দিল। ডেটোনেটর দিয়ে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হল যে, দরজাটি বিদ্যুতায়িত হয়েছে। খুশী হল মাহমুদ।
এবার সে ছুটে এল এমিলিয়ার কাছে। আবার নাকে হাত দিয়ে দেখল সব ঠিক আছে।
তাড়াতাড়ি সে তার বাধনগুলো কেটে তাকে গ্যাসমাষ্ক পরিয়ে কাঁধে তুলে নিল।
তারপর সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে নেমে এল ড্রেনের করিডোরে।
ফিরতি যাত্রা শুরু হলো তাদের।
এক হাতে কাঁধে এমিলিয়াকে ধরে, অন্য হাতে টর্চ জ্বালিয়ে আগে আগে হাটছিল মাহমুদ। তার পিছনে শেখ জামাল, সেই আগের মত করে।
এমিলিয়কে নিয়ে এসে তেলআবিব শহরের
পূর্বাঞ্চলে পার্ক ষ্ট্রীটের একটি বাড়ীতে এনে তোলা হল। বাড়ীটির সামনে সাইন
বোর্ড ‘দানিয়েল এ্যান্ড কোং’।
পূর্ব তেলআবিবে দানিয়েল এ্যান্ড কোম্পানীর প্রধান সেল্স ডিপো। বাড়ীটি জনৈক ইহুদীর নিকট থেকে অতি সম্প্রতি ক্রয় করেছে মাহমুদ। বাড়ীর বাইরের অংশে ক্রয়-বিক্রয়ের কাজ চলে আর ভিতরের অংশ ব্যবহৃত হয় সাইমুমের হাসপাতাল হিসেবে। একজন মহিলা ডাক্তার ও একজন নার্স এমিলিয়ার দেখা শোনার ভার নিল।
জ্ঞান ফিরে পেয়েই চোখ মেলল এমিলিয়া। সুন্দর খাটে নরম ধবধবে বিছানায় শুয়ে আছে সে। লাল কার্পেট মোড়া মেঝে। সাদা রং-এর দেয়াল। খাটের পাশে সাদা টেবিলে ঔষধের শিশি ও গ্লাস। কোথায় অপারেশন চেম্বারের শক্ত মেঝে, আর কোথায় জাকজমকপূর্ণ গৃহের নরম শয্যা। স্বপ্ন দেখছে না তো সে। গায়ে চিমটি কেটে দেখল-না স্বপ্ন নয়।
এমন সময় ঘরে ঢুকল নার্স। গায়ে সাদা আরবী পোশাক। মাথায় সাদা রুমাল। এমিলিয়াকে চাইতে দেখে সে দ্রুত তার পাশে এসে নরম গলায় বলল, কেমন লাগছে?
জবাব না দিয়ে এমিলিয়া বলল, আমি কোথায়? আপনি কে?
-আপনি নিরাপদ স্থানে আছেন। বলল নার্স।
কিছু বলার জন্য মুখ হা করেছিল এমিলিয়া। হঠাৎ ঘরে প্রবেশ করল মাহমুদ।
কথা বলতে পারল না এমিলিয়া। মুখ তার হা হয়েই রইলো অভিভূতের মত চেয়ে রইল সে মাহমুদের দিকে। ঠোঁট কাঁপতে লাগল তার। অবরুদ্ধ এক উচ্ছাসে কাঁপছে সে। উচ্ছাস ছাপিয়ে নেমে এল দু’গন্ড বেয়ে অশ্রুর ধারা। মুখ কাত হয়ে পড়ল বালিশে। বালিশে মুখ গুজে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল এমিলিয়া।
নার্স অনেক আগেই বেরিয়ে গিয়েছিল।
মাহমুদ ধীরে ধীরে গিয়ে এমিলিয়ার পাশে বসল। বলল, কেদোঁ না এমি, ভয়ংকর সে দুঃস্বপ্নের ইতি হয়েছে।
কান্না বেড়ে গেল এমিলিয়ার। কান্নার বেগে কাঁপছে তার দেহ।
এমিলিয়ার রেশমের মত নরম চুলে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে ইচ্ছ হচ্ছিল মাহমুদের। কিন্তু পারছিল না। বিবেকের কঠোর শাসানি তার সামনে। নতুন পরিবেশে, নতুন পরিচয়ে এমিলিয়া আজ এক মহিমাময়ী নারী। কাছে পেয়েও তাকে মনে হচ্ছে দুরে। সামান্য স্বোচ্ছাচারিতার অবকাশও তাদের মধ্যে নেই যেন আজ।
অবসাদে যেন ভেঙে পড়ছে এমিলিয়া। কান্না তার থেমে গেছে। কিন্তু মুখ তুলছে না সে।
নার্স গরম দুধ নিয়ে ঘরে ঢুকলো। মাহমুদ পাশের একটি চেয়ারে গিয়ে বসেছিল। এমিলিয়াকে দুধ খাইয়ে চলে গেল নার্স। মাহমুদ বলল, এখন উঠি এমি, সকালে আসব।
-কোথায় যাবে, আমি কোথায়? অষ্ফুট প্রায় একটি প্রশ্ন।
-কেন নিজের বাড়ীতে। মাহমুদের ঠোঁটে হাসি।
এমিলিয়া কোন জবাব দিল না। চোখ দু’টি নামিয়ে নিল সে। মাহমুদ বলল, কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?
-বিদ্রুপ করছ তুমি আমাকে মাহমুদ? এমিলিয়ার কণ্ঠ ভারি শোনাল।
-বিদ্রুপ নয়, সত্যি বলছি, আমি এ বাড়ীতে থাকি না বটে, তবে এটা আমারই বাড়ী।
এমিলিয়া কোন কথা বলল না। নীরব দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল শুধু। দৃষ্টিতে তার সে কি বিশ্বাস আর নির্ভরতা।
মাহমুদই কথা বলল আবার, তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমরা করেছি কোন ভয় নেই। একটু থেমে মাহমুদ আবার বলল, আমি তোমাকে একেবারে আমার ওখানেই তুলতে পারতাম, কিন্তু তা করিনি। তুমি তো জান, আমার শূন্য ঘরে তোমার পদধুলি পড়বে, সে সৌভাগ্যের দিন আমার এখনো আসেনি। বলেই মাহমুদ উঠে দাঁড়াল। বলল এখানে যারা আছে যাদের তুমি দেখবে, সকলকেই নিজের লোক মনে করো। যে কোন অসুবিধার কথা তাদের জানিও।
মাহমুদ বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
এমিলিয়া অপসৃয়মান মাহমুদের দিকে চেয়েছিল। তার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বালিশ দু’হাতে আঁকড়ে ধরে মুখ লাগালো সে বালিশে।
পূর্ব তেলআবিবে দানিয়েল এ্যান্ড কোম্পানীর প্রধান সেল্স ডিপো। বাড়ীটি জনৈক ইহুদীর নিকট থেকে অতি সম্প্রতি ক্রয় করেছে মাহমুদ। বাড়ীর বাইরের অংশে ক্রয়-বিক্রয়ের কাজ চলে আর ভিতরের অংশ ব্যবহৃত হয় সাইমুমের হাসপাতাল হিসেবে। একজন মহিলা ডাক্তার ও একজন নার্স এমিলিয়ার দেখা শোনার ভার নিল।
জ্ঞান ফিরে পেয়েই চোখ মেলল এমিলিয়া। সুন্দর খাটে নরম ধবধবে বিছানায় শুয়ে আছে সে। লাল কার্পেট মোড়া মেঝে। সাদা রং-এর দেয়াল। খাটের পাশে সাদা টেবিলে ঔষধের শিশি ও গ্লাস। কোথায় অপারেশন চেম্বারের শক্ত মেঝে, আর কোথায় জাকজমকপূর্ণ গৃহের নরম শয্যা। স্বপ্ন দেখছে না তো সে। গায়ে চিমটি কেটে দেখল-না স্বপ্ন নয়।
এমন সময় ঘরে ঢুকল নার্স। গায়ে সাদা আরবী পোশাক। মাথায় সাদা রুমাল। এমিলিয়াকে চাইতে দেখে সে দ্রুত তার পাশে এসে নরম গলায় বলল, কেমন লাগছে?
জবাব না দিয়ে এমিলিয়া বলল, আমি কোথায়? আপনি কে?
-আপনি নিরাপদ স্থানে আছেন। বলল নার্স।
কিছু বলার জন্য মুখ হা করেছিল এমিলিয়া। হঠাৎ ঘরে প্রবেশ করল মাহমুদ।
কথা বলতে পারল না এমিলিয়া। মুখ তার হা হয়েই রইলো অভিভূতের মত চেয়ে রইল সে মাহমুদের দিকে। ঠোঁট কাঁপতে লাগল তার। অবরুদ্ধ এক উচ্ছাসে কাঁপছে সে। উচ্ছাস ছাপিয়ে নেমে এল দু’গন্ড বেয়ে অশ্রুর ধারা। মুখ কাত হয়ে পড়ল বালিশে। বালিশে মুখ গুজে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল এমিলিয়া।
নার্স অনেক আগেই বেরিয়ে গিয়েছিল।
মাহমুদ ধীরে ধীরে গিয়ে এমিলিয়ার পাশে বসল। বলল, কেদোঁ না এমি, ভয়ংকর সে দুঃস্বপ্নের ইতি হয়েছে।
কান্না বেড়ে গেল এমিলিয়ার। কান্নার বেগে কাঁপছে তার দেহ।
এমিলিয়ার রেশমের মত নরম চুলে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে ইচ্ছ হচ্ছিল মাহমুদের। কিন্তু পারছিল না। বিবেকের কঠোর শাসানি তার সামনে। নতুন পরিবেশে, নতুন পরিচয়ে এমিলিয়া আজ এক মহিমাময়ী নারী। কাছে পেয়েও তাকে মনে হচ্ছে দুরে। সামান্য স্বোচ্ছাচারিতার অবকাশও তাদের মধ্যে নেই যেন আজ।
অবসাদে যেন ভেঙে পড়ছে এমিলিয়া। কান্না তার থেমে গেছে। কিন্তু মুখ তুলছে না সে।
নার্স গরম দুধ নিয়ে ঘরে ঢুকলো। মাহমুদ পাশের একটি চেয়ারে গিয়ে বসেছিল। এমিলিয়াকে দুধ খাইয়ে চলে গেল নার্স। মাহমুদ বলল, এখন উঠি এমি, সকালে আসব।
-কোথায় যাবে, আমি কোথায়? অষ্ফুট প্রায় একটি প্রশ্ন।
-কেন নিজের বাড়ীতে। মাহমুদের ঠোঁটে হাসি।
এমিলিয়া কোন জবাব দিল না। চোখ দু’টি নামিয়ে নিল সে। মাহমুদ বলল, কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?
-বিদ্রুপ করছ তুমি আমাকে মাহমুদ? এমিলিয়ার কণ্ঠ ভারি শোনাল।
-বিদ্রুপ নয়, সত্যি বলছি, আমি এ বাড়ীতে থাকি না বটে, তবে এটা আমারই বাড়ী।
এমিলিয়া কোন কথা বলল না। নীরব দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল শুধু। দৃষ্টিতে তার সে কি বিশ্বাস আর নির্ভরতা।
মাহমুদই কথা বলল আবার, তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমরা করেছি কোন ভয় নেই। একটু থেমে মাহমুদ আবার বলল, আমি তোমাকে একেবারে আমার ওখানেই তুলতে পারতাম, কিন্তু তা করিনি। তুমি তো জান, আমার শূন্য ঘরে তোমার পদধুলি পড়বে, সে সৌভাগ্যের দিন আমার এখনো আসেনি। বলেই মাহমুদ উঠে দাঁড়াল। বলল এখানে যারা আছে যাদের তুমি দেখবে, সকলকেই নিজের লোক মনে করো। যে কোন অসুবিধার কথা তাদের জানিও।
মাহমুদ বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
এমিলিয়া অপসৃয়মান মাহমুদের দিকে চেয়েছিল। তার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বালিশ দু’হাতে আঁকড়ে ধরে মুখ লাগালো সে বালিশে।
সেদিন এমিলিয়ার মা আইরিনা তার ঘরে
এমিলিয়ার ফটো সামনে নিয়ে বসেছিল। মায়ের কয়েক ফোটা অশ্রু গিয়ে পড়েছে
এমিলিয়ার বাধানো ফটোর আয়নায়। এমিলিয়া চলে যাবার পর থেকে এভাবেই কাঁদছে
আইরিনা। আইরিনা সেই যে সিনবেথ অফিসে গেছে, তারপর আর কোন খোঁজ নেই তার।
এতটুকুই শুধু জানা গেছে যে, তার জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এ জিজ্ঞাসাবাদ কেমন তা
ভাবতেও শিউরে উঠে আইরিনা। সেই থেকে এমিলিয়ার বাবাও বোবা হয়ে গেছে। কোন
কথাই সে বলে না। আইরিনার অনেক কাদাকাটার পর গতকাল শুধু একটা কথাই বলেছিল,
মেয়েটা আমার সসম্মানে মৃত্যুবরণ করতে পারুক, এর চেয়ে বেশী আর কিছু চেয়ো না
আইরিনা। কিন্তু ওরা তো মারবে না, কষ্ট দেবে। এ কষ্ট দেবার টেকনিক আমরা
হিটলারের কাছে শিখে এসেছি।’ স্বামীর এ কথাগুলো মনে পড়ায় আবার নতুন করে
কেঁপে উঠল আইরিনা, অশ্রুর ঢল নামল দু’চোখ বেয়ে।
এ সময় একটা খবরের কাগজ হাতে ঘরে প্রবেশ করল ডেভিড সালেম। কাগজের একটা খবর স্ত্রীর কাছে মেলে ধরে বলল, পড়।
চোখ মেলে স্বামীর দিকে চেয়ে খবরের ওপর চোখ নিবদ্ধ করল আইরিনা। খবরটির শিরোনাম এরূপ,
“সিনবেথের দুর্ভেদ্য অপারেশন কক্ষ
থেকে আসামীর পলায়ন”
আর খবরে বলা হয়েছে, গতকাল রাতে সিনবেথের ভূগর্ভস্থ অপারেশন কক্ষ থেকে অতি গোপনীয় রাষ্ট্রীয় দলিল পাচারের দায়ে ধৃত আসামী জনৈকা এমিলিয়া পলায়ন করেছে। জানা গেছে, কে বা কারা ভূগর্ভস্থ ড্রেনের পথে দৃঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে সিনবেথের অপারেশন কক্ষ থেকে তাকে উদ্ধার করে নিরাপদে পালিয়ে গেছে।…..
খবরটা পড়া শেষ না করেই আইরিনা স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ঈশ্বর আমাদের দেখেছেন, আমাদের মেয়েকে বাঁচিয়েছেন।’
ডেভিড সালেমের চোখেও তখন অশ্রু।
এ সময় দরজায় নক হলো।
আইরিনা স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ইসাকের মা এস।
পরিচারিকা ইসাকের মা ঘরে প্রবেশ করে একটা চিঠি ডেভিড সালেমের হাতে দিল।
সাদা দামী ইনভেলাপ। এ ধরনের ইনভেলাপের ব্যবহার ইসরাইলে নেই। ইনভেলাপের ওপর কারও নাম লেখা নেই। বিষ্মিত ডেভিড সালেম ইনভেলাপ ছিঁড়ে একটা চিঠি বের করল। চিঠির কাগজটিও অত্যন্ত দামী। চিঠিটি পড়ল ডেভিড সালেম,
সম্মানিত ডেভিড সালেম,
আপনাদের মেয়ে এমিলিয়া ভাল আছেন, সুস্থ আছেন। নিরাপদ মনে করলে আপনাদের কাছেই পাঠাতাম। কিন্তু তা পারছি না।
-মাহমুদ
চিঠিটি পড়ে ডেভিড সালেম বলল, কোথায় পেলে ইসাকের মা এই চিঠি?
ইসাকের মা বলল, একজন ফুলওয়ালা এই চিঠি দিয়ে গেছে। ইসাকের মা বেরিয়ে গেল।
আইরিনা চিঠিটি পড়ে মেঝেতেই সেজদায় পড়ে গেল মুসার খোদার উদ্দেশ্য।
সেজদা থেকে উঠে আবেগ জড়িত কন্ঠে বলল, বলতে পার এই মাহমুদ কে?
ডেভিড সালেম বলল, কে আমি জানি না, অনুমান করতে পারি, সাইমুমরা ছাড়া এ দেশে এত শক্তিশালী আর কেউ নেই।
একটু থেমে সে বলল, মাহমুদ যদি সাইমুমের হয় তাহলে আমাদের মেয়ে সম্পর্কে আমরা নিরাপদ থাকতে পারি।
এ সময় টেলিফোন বেজে উঠল।
ডেভিড সালেম টেলিফোন ধরলে ওপার থেকে সিনবেথ প্রধান ডোবিন বলল, স্যার আমরা আপনার সহযোগিতা চাই। এমিলিয়ার কোনও তথ্য যদি পান…..
ডেভিড সালেম ডোবিনকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলল তোমার কথা আমি বুঝেছি ডোবিন। আমার অবস্থা তুমি জান, পরে কথা বলব তোমার সাথে।
বলে টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে এসে আইরিনার হাত থেকে চিঠিটি নিয়ে ছিড়ে ফেলল। চিঠি ছিড়তে ছিড়তে সে বলল, বুঝলে আইরিনা ডোবিন আমার কাছ থেকে এমিলিয়ার খোঁজ চায়। ওরা ভুল করছে। আমি ইহুদী বটে’ কিন্তু আমি একজন পিতাও ঐ অমানুষরা তা ভুললো কি করে।
এ সময় একটা খবরের কাগজ হাতে ঘরে প্রবেশ করল ডেভিড সালেম। কাগজের একটা খবর স্ত্রীর কাছে মেলে ধরে বলল, পড়।
চোখ মেলে স্বামীর দিকে চেয়ে খবরের ওপর চোখ নিবদ্ধ করল আইরিনা। খবরটির শিরোনাম এরূপ,
“সিনবেথের দুর্ভেদ্য অপারেশন কক্ষ
থেকে আসামীর পলায়ন”
আর খবরে বলা হয়েছে, গতকাল রাতে সিনবেথের ভূগর্ভস্থ অপারেশন কক্ষ থেকে অতি গোপনীয় রাষ্ট্রীয় দলিল পাচারের দায়ে ধৃত আসামী জনৈকা এমিলিয়া পলায়ন করেছে। জানা গেছে, কে বা কারা ভূগর্ভস্থ ড্রেনের পথে দৃঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে সিনবেথের অপারেশন কক্ষ থেকে তাকে উদ্ধার করে নিরাপদে পালিয়ে গেছে।…..
খবরটা পড়া শেষ না করেই আইরিনা স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ঈশ্বর আমাদের দেখেছেন, আমাদের মেয়েকে বাঁচিয়েছেন।’
ডেভিড সালেমের চোখেও তখন অশ্রু।
এ সময় দরজায় নক হলো।
আইরিনা স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ইসাকের মা এস।
পরিচারিকা ইসাকের মা ঘরে প্রবেশ করে একটা চিঠি ডেভিড সালেমের হাতে দিল।
সাদা দামী ইনভেলাপ। এ ধরনের ইনভেলাপের ব্যবহার ইসরাইলে নেই। ইনভেলাপের ওপর কারও নাম লেখা নেই। বিষ্মিত ডেভিড সালেম ইনভেলাপ ছিঁড়ে একটা চিঠি বের করল। চিঠির কাগজটিও অত্যন্ত দামী। চিঠিটি পড়ল ডেভিড সালেম,
সম্মানিত ডেভিড সালেম,
আপনাদের মেয়ে এমিলিয়া ভাল আছেন, সুস্থ আছেন। নিরাপদ মনে করলে আপনাদের কাছেই পাঠাতাম। কিন্তু তা পারছি না।
-মাহমুদ
চিঠিটি পড়ে ডেভিড সালেম বলল, কোথায় পেলে ইসাকের মা এই চিঠি?
ইসাকের মা বলল, একজন ফুলওয়ালা এই চিঠি দিয়ে গেছে। ইসাকের মা বেরিয়ে গেল।
আইরিনা চিঠিটি পড়ে মেঝেতেই সেজদায় পড়ে গেল মুসার খোদার উদ্দেশ্য।
সেজদা থেকে উঠে আবেগ জড়িত কন্ঠে বলল, বলতে পার এই মাহমুদ কে?
ডেভিড সালেম বলল, কে আমি জানি না, অনুমান করতে পারি, সাইমুমরা ছাড়া এ দেশে এত শক্তিশালী আর কেউ নেই।
একটু থেমে সে বলল, মাহমুদ যদি সাইমুমের হয় তাহলে আমাদের মেয়ে সম্পর্কে আমরা নিরাপদ থাকতে পারি।
এ সময় টেলিফোন বেজে উঠল।
ডেভিড সালেম টেলিফোন ধরলে ওপার থেকে সিনবেথ প্রধান ডোবিন বলল, স্যার আমরা আপনার সহযোগিতা চাই। এমিলিয়ার কোনও তথ্য যদি পান…..
ডেভিড সালেম ডোবিনকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলল তোমার কথা আমি বুঝেছি ডোবিন। আমার অবস্থা তুমি জান, পরে কথা বলব তোমার সাথে।
বলে টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে এসে আইরিনার হাত থেকে চিঠিটি নিয়ে ছিড়ে ফেলল। চিঠি ছিড়তে ছিড়তে সে বলল, বুঝলে আইরিনা ডোবিন আমার কাছ থেকে এমিলিয়ার খোঁজ চায়। ওরা ভুল করছে। আমি ইহুদী বটে’ কিন্তু আমি একজন পিতাও ঐ অমানুষরা তা ভুললো কি করে।
No comments:
Post a Comment