অপারেশন তেলআবিব-১ অধ্যায়-১১ Saimum Series - 1

অধ্যায়-১১
পরিষ্কার নীলাকাশ। উইলো গাছ আর জলপাইকুঞ্জে সকালের  রোদ ঝিলমিল করছে। কোরআন শরীফ বন্ধ করে টিবিলে রেখে এসে মাহমুদ চেয়ারে বসল। সেদিনের দৈনিক কাগজ এসে গেছে, সে দেখতে পেল।
কাগজটি উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল মাহমুদ। সিংগল কলাম হেডিং এর একটি ছোট্ট খবরে মাহমুদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। ‘‘বেনগুরিয়ান তনয়ার জন্ম বার্ষিকী।’’ খবরটিতে বেনগুরিয়ান তনয়া এমিলিয়ার একবিংশ জন্ম বার্ষিকী অনুষ্ঠান সূচীর কিছু পরিচয় দেয়া হয়েছে।
এমিলিয়ার নাম মনে পড়তেই মাহমুদের স্নায়ুতন্ত্রীতে এক উত্তপ্ত স্রোত বয়ে গেল। মায়াময় নীল দু’টি চোখ বেদনাপীড়িত মুখ শুভ্রগন্ডে অশ্রুর দু’টি ধারা – বিদায় মুহূর্তের এমিলিয়া মাহমুদের মানসচোখে ফুটে উঠল। মনে পড়ল তার সেই করুণ আকুতি আবার কবে দেখা হবে?’’ মাহমুদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি এ পর্যন্ত। অনেকবার মনে হয়েছে কিন্তু মাহমুদ চায়নি ফুলের মত সুন্দর ঐ জীবনটির উপর কোন সন্দেহের মেঘ নেমে আসুক – কোন অসুবিধায় পড়ুক সে। আজ ওর পরম খুশির দিন। মাহমুদ কি পারে না এই খুশির দিনে তার পাশে দাঁড়াতে। মাহমুদের ঠোঁটে ফুটে উঠল এক
রহস্যময় হাসি। স্বগতঃ তার কন্ঠে উচ্চারিত হলো – পারি, কিন্তু আকাঙ্খার পরিতৃপ্তিকে জ্ঞান ও কর্তব্যের উর্ধ্বে স্থান দিতে পারি না আমি।
সা’দ আলি ঘরে ঢুকল। পায়ের শব্দে পিছনে ফিরে চাইতেই সা’দ বলল, ‘‘হেড কোয়ার্টারের মেসেজ জনাব।’’
মাহমুদ তাড়াতাড়ি হাত পেতে কাগজটি নিল। দ্রুত চোখ বুলাল কাগজটিতেঃ
World peace brigade এর অধিনায়ক মেজর জেনারেল ওয়ালটার কুট এর বিশেষ প্রতিনিধি হুগো গালার্ট গোপনে তেলআবিব আসছেন। তিনি ১১ তারিখ সন্ধ্যায় বৃটিশ রয়াল এয়ারফোর্সের বিশেষ বিমান যোগে রাত ৯ টা ২৫ মিনিটের সময় তেলআবিব নামছেন।
মাহমুদ স্মরণ করল, মেজর জেনারেল ওয়াল্টার মুটের ইহুদী নাম জেরম ইজাক রোমেন। সুইচ আর্মির প্রাক্তন অফিসার। ওয়াল্টার কুট নাম নিয়েছেন তিনি। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক গোপন ইহুদী আন্দোলনের ইনি একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। আর হুগো গালার্ট হচ্ছেন বার্লিনের দুর্দান্ত ইহুদী জ্যাকব গ্রিমব।
এগার তারিখ অর্থাৎ আজ রাত ৯-২৫ মিনিটে হুগো গালার্ট নামছেন তেলআবিবে। মনে মনে হিসাব করলো মাহমুদ।
গভীর চিন্তায় ডুবে গেল সে। হুগো গালার্ট কি মিশন নিয়ে আসছে? কোন মেসেজ বা কোন গোপন তথ্য? তাই হবে হয়তো। কিন্তু সে সব লিখিতভাবে না মৌখিক কানে কানে। হুগো গালার্ট যখন প্রতিনিধি মাত্র তখন তার মারফতে লিখিত মেসেজ বা তথ্য আসবে, সেটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু কোন পথে এগুনো যাবে? হুগো যদি পূর্বাহ্নে তার বিপদ আঁচ করতে পারে, তাহলে সব প্রয়োজনীয় রেকর্ড নষ্ট করে ফেলবে। এজন্য এমন স্বাভাবিক পথ অনুসরণ করতে হবে যা হুগোর মনে কোন সন্দেহের উদ্রেক করবে না। চিন্তা করল মাহমুদ।
মাহমুদ হিসেব করল, বিমান বন্দর থেকে তেলআবিব ৯ মাইল। মিডিয়াম স্পিড যদি ধরা যায় তাহলে এই ৯ মাইল পথ অতিক্রম করতে ৭ থেকে ৯ মিনিট সময় লাগবে। এই সময়কেই কাজে লাগাতে হবে। বহনকারী তথ্যকে হস্তান্তরের সামান্য সুযোগও হুগোকে দেয়া চলবে না। অবশ্য বিমান বন্দরেই হুগো এটা করে ফেলেন কিনা তাও দেখতে হবে।
মনে মনে পরিকল্পনার এক ছক এঁকে নিল মাহমুদ। তারপর শেখ জামাল, আফজল ও হাসান কামালকে ডেকে তাদের সাথে পরামর্শ করে।
রাত ৮ টা ৪৫ মিনিট। মাহদুদ তার কার্ডিলাক নিয়ে বের হলো। বালফোর রোড গিয়ে পড়েছে এয়ার পোর্ট রোড ধরে ছুটে চলল। এয়ারপোর্টে মাহমুদ যখন পৌঁছল তখন ৮ টা ৫৬ মিনিট।
‘সিনবেথ’ এর নয়া তেলআবিব প্রধান মিঃ বেকম্যান ওয়েটিং রুমের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে একটি ম্যাগাজিনের উপর চোখ বুলাচ্ছে। মাহমুদ তার সামনের সোফাটিতে বসে পড়ল। মনে মনে ভবল, ভালই হলো। যাত্রা শুভ।
৯ টা বিশ বাজল। মিঃ বেকম্যান উঠে দাঁড়াল। সে হলের দোর গোড়ায় দাঁড়াতেই একজন লোক এসে তার সামনে দাঁড়াল। মিঃ ব্যাকম্যান তাকে কি যেন বললো, তারপর ফিরে এলো আবার। সোফা থেকে চশমা আর ম্যাগাজিনটি তুলে নিয়ে ঢুকে গেলো ভিতরে। মাহমুদ বুঝলো, রানওয়েতে হুগোকে অভ্যর্থনা জানানোর বন্দোবস্ত এটা। বেকম্যান উঠে যাবার পর মাহমুদও উঠে গিয়ে এদিক ওদিক পায়চারী করল। মাহমুদ দেখতে পেল, আফজল বিশেষ অতিথিদের দরজাটির আশেপাশেই রয়েছে। যদিও মাহমুদ স্থির নিশ্চিত যে সাধারণ যাত্রী নির্গমনের পথ দিয়ে ওরা বেরোবে না, সময় বাঁচানোর জন্য ওরা ভি আই পি’র পথই বেছে নিবে। তবু মাহমুদ অতিরিক্ত এ ব্যবস্থা করে রেখেছে।
ঠিক ৯-২৬ মিনিটে রায়াল এয়ারফোর্সের একটি বিমান রানওয়েতে ল্যান্ড করল। সিনবেথের গাড়ী দাঁড় করানো ছিল ওয়েটিং রুমের পূর্ব পার্শ্বের দরজার বামপাশে। আর মাহমুদ তার গাড়ী দাঁড় করিয়েছিল হলের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের দরজার সামনে। ৯ – ৪০ মিনিটে একটি বোয়িং তেলআবিব থেকে যাত্রা করছে, সেজন্য যাত্রী ও তাদের বন্ধু বান্ধবদের আনাগোনায় বেশ ভীড় জমে উঠেছে।
মিঃ বেকম্যান একজন লোকের সাথে সহাস্যে কথা বলতে বলতে কর্মচারী আগমণ নির্গমনের বিশেষ দরজা দিয়ে বের হয়ে এল। লোকটির পরিধানে কালো রংএর স্যুট, হাতে সুদৃশ্য একটি এটাচী। মাথায় হ্যাট কপাল পর্যন্ত নামানো নাকের নীচে হিটলারী কায়দার গোঁফ। গল্প করতে করতে ওরা দরজার দিকে এগোলো। মাহমুদ দেখতে পেল, ওদের কয়েক গজ পিছনে আফজল এসে দাঁড়িয়েছে। আফজল ওদের পিছনে গিয়ে দরজায় মুহূর্তকাল দাঁড়িয়ে ফিরে এল। আফজল ফেরার সাথে সাথে মাহমুদ নিজের গাড়ীর দিকে চলল। মাহমুদ গাড়ীতে উঠতে উঠতে দেখতে পেল আফজল টেলিফোন বুথের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। মাহমুদের মুখে ফুটে উঠল প্রশান্তির হাসি। পেছনের সিটে শুয়ে হাসান কামাল ঘুমের কসরত করছিল। মাহমুদকে গাড়ীতে উঠতে দেখে নড়ে চড়ে ঠিক হয়ে বসল সে।
মাহমুদের গাড়ী এয়ারপোর্ট চত্বরের দ্বিতীয় গেট দিয়ে বেরিয়ে এয়ারপোর্ট রোডে পড়ল। প্রায় ৩০০ গজ সামনে আর একটি কালো রং এর গাড়ী এয়ারপোর্ট রোড ধরে এগিয়ে চলছে। রেয়ার লাইটের আলোকে গাড়ীর নাম্বার প্লেটটি দেখে মাহমুদের ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে গেল। তার মুখে স্বগতঃ উচ্চারিত হলো, ইন্না ছালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামতি লিল্লাহে রাবিবল আলামিন (নিশ্চয় আমার উপাসনা প্রার্থনা আমার সাধনা, আমার জীবন, আমার মরণ সমস্তই বিশ্ব নিয়ন্তা রাব্বুল আলামিন আল্লাহর নামে নিবেদিত)। মাহমুদ গাড়ীর স্পিড একটু কমিয়ে দিল, কিন্তু গাড়ীটিকে চোখের আড় হতে দিল না। পিছনে সংকেত থেকে সে বুঝে নিল, ওটা আফজলের গাড়ী।
চার মাইল পথ এসেছে তারা। সামনেই রাস্তাটি বামদিকে বাঁক নিয়েছে। মাহমুদ অধীর আগ্রহে সামনে তাকিয়েছিল। অবশেষে দেখতে পেল, একটি উজ্জ্বল হেড লাইট/ সঙ্গে সঙ্গে মাহমুদ তার নিজের হেড লাইট থেকে কয়েকবার সংকেত দিল। সংকেতের উত্তর পেল সামনের তীব্রবেগে এগিয়ে আসা হেড লাইট থেকে। স্বস্তি লাভ করল মাহমুদ -শেখ জামাল ঠিক সময়ে পৌছেছে। কিছু  দূরেই মোড়। শেখ জামালের গাড়ীর হেড লাইট থেকে বুঝা যাচ্ছে প্রায় মোড়ের সন্নিকটে পৌছে গিয়েছে সে। ওদিকে এগিয়ে চলা মিঃ বেকম্যানের গাড়িটিও মোড়ের সন্নি্কটে পৌছে গেছে। মিঃ জামালের গাড়ীর হেড লাইটের আলোতে মিঃ বেকম্যানের গাড়ী এবার স্পষ্ট হয়ে উঠল। মাত্র মুহূর্তকয়েকের ব্যবধান। সামনে থেকে তীক্ষ্ণ এক ধাতব সংঘর্ষের শব্দ শোনা গেল। মাহমুদ চঞ্চল হয়ে উঠল। দ্রুত এগিয়ে গেল তার গাড়ী। পাশ দিয়ে প্রচন্ড বেগে শেখ জামালের পাঁচ টনি ট্রাক বেরিয়ে গেল।
মোড়ে এসে দ্রুত গাড়ী থেকে নেমে মাহমুদ দেখল, মিঃ বেকম্যানের গাড়ীটি একপাশে কাত হয়ে পড়ে গেছে। গাড়ীর ডানপাশের অংশ দুমড়ে গেছে। ড্রাইভার তার সিটের একপাশে কাত হয়ে পড়ে আছে। ধীরে ধীরে উঠবার চেষ্টা করছে সে। মিঃ বেকম্যানের কপালে আঘাতে লেগেছে, রক্ত বেরুচ্ছে। সে নিঃসাড়ভাবে পড়ে আছে। বোঝা গেল না জ্ঞান হারিয়েছে কিনা। মিঃ হুগো মিঃ বেকম্যানের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন, এটাচী কেসটি কিন্তু তার হাতছাড়া হয়নি। মাহমুদ গাড়ীর কাছে পৌছতেই সে উঠে বসতে চেষ্টা করল। মাহমুদ হুগোকে বলল, ‘‘বেরিয়ে আসুন।’’ বলে মাহমুদ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল। বের করে এনে তাকে নিজের গাড়ীর কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘‘বসুন ভিতরে গিয়ে।’’
মিঃ হুগো কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠলেন। কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার হাত থেকে এটাচী কেসটি কেড়ে নিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসতে বসতে বলল মাহমুদ, ‘‘হাসান কামাল, মিঃ হুগোকে এবার ঘুমিয়ে দাও।
মাহমুদ বলার আগেই হাসান কামাল তার কাজে লেগে গিয়েছিল। কয়েকবার ঝটপট করলেন মিঃ হুগো, কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে এল তার দেহ।
গাড়ী ছেড়ে দিল মাহমুদ। সব কাজ সম্পন্ন করতে তার আধ মিনিটের মত সময় লাগল। আফজলের গাড়ী যখন মোড়ে পৌছল, মাহমুদের গাড়ী তখন চলে গেছে কয়েকশ গজ সামনে। আফজলের পর আরো কয়েকটি গাড়ী এসে পৌছল। একটি হৈ চৈ পড়ে গেল চারদিকে।
এই সময় মিঃ বেকম্যানের জ্ঞান ফিরে এল। চারিদিকে চেয়ে প্রথমেই সে বলল, ‘‘মিঃ হুগো ………….।’’ একটু থেমে ঢোক গিলে পুনরায় সে বলল, ‘‘গাড়ীতে আর এক জন লোক ছিল, সে কোথায়? ’’
উপস্থিত কেউ এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। ড্রাইভার তখনও সীটের উপর পড়েছিল। তার মাথার ও বুকে আঘাত লেগেছে। সে ধীরে ধীরে বলল, ‘‘দুর্ঘটনার পরেই একটি গাড়ী তাকে তুলে নিয়ে গেছে।’’
-তুলে নিয়ে গেছে। সে কি গুরুতর আহত ছিল? তার কণ্ঠ যেন কেঁপে উঠল।
– আমি জানি না, তবে বুঝতে পেরেছিলাম তার জ্ঞান ছিল।
আর কোন প্রশ্ন করল না বেকম্যান। চোখ বুজে মুহুর্তকয় চিন্তা করে উঠে দাঁড়াল। আঘাতের কথা সে যেন ভুলে গেছে। বলল সে, ‘‘এখনি পৌঁছতে হবে হেড কোয়ার্টারে।’’
অনেকেই তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। মিঃ বেকম্যানকে গাড়ী এগিয়ে চলল ‘সিনবেথ’ এর হেড কোয়ার্টার এর দিকে। মিঃ বেকম্যানের লক্ষ্য বুঝতে পারল আফজল। মাহমুদের পশ্চাৎদিকের নিরাপত্তায় মোতায়েন আফজল এবার নিশ্চিন্ত হয়ে তার গাড়ী ছেড়ে দিল।
ওয়াইজম্যান রোডের একটি প্রকান্ড বাড়ী। বাইরে থেকে দেখতে একটি সাদমাটা ত্রিতল। কিন্তু ভিতরে গেলে বুঝা যায় বাড়ীর বিরাটত্ব। প্রকান্ড গাড়ী বারান্দা। পাঁচ ছয়টি গাড়ী খুব সহজভাবেই এখানে স্থান পেতে পারে। সব মিলে খান তিরিশেক ঘর। মেঝের তল দিয়ে বিলম্বিত এক সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে সবগুলো ঘরকে ইন্টারকানেক্টেড করা হয়েছে। পরিশেষে এই সুড়ঙ্গ পথ ওয়াইজম্যান রোডের দক্ষিন পার্শ্ব দিয়ে সমান্তরালভাবে চলে যাওয়া মরদেশাই রোডের একটি ফলের দোকানে গিয়ে শেষ হয়েছে। তেলআবিবে সাইমুমের এটা চতুর্থ আস্তানা।
মাহমুদ মিঃ হুগো গালার্টকে এই আস্তানাতে এনে তুলল। বাইরের কোন লোককে সাইমুম কখনও তাদের মূল ঘাঁটিতে নিয়ে যায় না। এমন কি দলীয় সদস্যদেরও যোগাযোগ কেন্দ্র এই আস্তানাগুলো। মূল ঘাঁটির অধিকতর নিরাপত্তার জন্যই এই ব্যবস্থা।
হুগো গালার্টকে সার্চ করা হলো। তার বৃহদাকার এটাচী থেকে পাওয়া গেল হুগোর প্রয়োজনীয় কিছু কাপড়। আর পাওয়া গেল একটা ডাইরী এবং কিছু পাউন্ড মুদ্রা। ডাইরীতে হুগোর নিজস্ব খরচ পত্রের খুঁটিনাটি এবং তার কিছু ট্যুর রেকর্ড। ডইরীর মধ্যে পাওয়া গেল World peace Brigade এর অধিনায়ক মিঃ ওয়াল্টার কুটের নিজস্ব প্যাডের একটি চার ভাঁজ করা সাদা পাতা।
হুগোর জুতার তলা এবং তার পায়ের পাতা থেকে শুরু করে মাথার চুল পর্যন্ত সব কিছুই তন্ন তন্ন করে সার্চ করা হলো। তার পোশাকের সন্দেহজনক কোন অংশই বাদ দেয়া হলো না। অবশেষে হুগোর এটাচী কেস ফেঁড়ে ফেলা হলো, তার অতিরিক্ত কাপড় চোপড় গুলো ও পরীক্ষা করা হলো। কিন্তু কিছুই মিলল না।
কপালের ঘাম মুছে শেখ জামাল এসে চেয়ারে ধপ করে বসল। মাহমুদ চেয়ে চেয়ে দেখছিল/ শেখ জামাল বসতেই মাহমুদ মিঃ হুগোর দিকে চেয়ে বলল, ‘‘মিঃ হুগো আপনি কি হাওয়া খাওয়ার জন্য গোপন সফরে তেলআবিব এসেছেন?’’
মিঃ হুগো শুধু মিট মিট করে চাইলেন। কোন উত্তর এল না তার কাছ থেকে। মাহমুদ জানে, হুগো ওরফে জ্যাকব গ্রিমবের মুখ খোলার জন্য মুখের কথা যথেষ্ট নয়। মাহমুদ হুগোকে আর কিছু বলল না। গভীর চিন্তায় আবার ডুব দিল সে।
হঠাৎ সোজা হয়ে বসল মাহমুদ। মুখ তার খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার মনে পড়ে গেল, লেনিন যখন জেলে ছিলেন তখন তাঁর স্ত্রী তার কাছে পড়ার জন্য ম্যাগাজিন পাঠাতো। লেনিন ম্যাগাজিনের সাদা অংশগুলোতে দুধ দিয়ে তাঁর মেসেজ লিখতেন কর্মীদের উদ্দেশ্যে। দুধের এ লেখাগুলো এমনিতে দেখা যেত না, কিন্তু পানিতে ডোবালেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠত। লেনিনের স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে ম্যাগাজিন ফেরত নিয়ে গিয়ে মেসেজগুলো উদ্ধার করে পৌঁছাতেন কর্মীদের নিকট।
কথাটা মনে হতেই মাহমুদ শেখ জামালকে নির্দেশ দিলেন এক গামলা পানি আনতে।
পানি এলে মিঃ হুগোর ডাইরী থেকে ওয়াল্টার কুটের প্যাডের চার ভাঁজ পাতাটি এনে ভাঁজ খুলে পানিতে ডুবিয়ে দিল।
সাফ্যলের আনন্দ খেলে গেল মাহমুদের মুখে। কাগজের বুকে সাদা সাঁদা অক্ষর ফুটে উঠেছে। মাহমুদ শেখ জামালকে বলল, ‘‘তাড়াতাড়ি কাগজ কলম আনো। কাগজ বেশীক্ষণ পানিতে রাখা যাবে না।
শেখ জামাল মাহমুদের অনুসরণ করে লিখ যেতে লাগলঃ
‘‘প্রেরক ওয়াল্টার কুট, অধিনায়ক বিশ্ব শান্তি সেনা।
-প্রাপক স্যামুয়েল শার্লটক, প্রধানমন্ত্রী, ইসরাইল।
আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, যুদ্ধ বিরতি সীমারেখার ওপারে যুদ্ধবিরতি তদারককারীদের মধ্যে আমরা কিছু ইসরাইল সন্তানকে সন্নিবিষ্ট করতে পেরেছি। ‘ইরগুন জাই লিউমি’র মাধ্যমে তারা তথ্য সরবরাহ করবে। কিন্তু জরুরী পরিস্থিতিতে যোগাযোগের জন্য আমরা তাদের রেডিও মিটার পাঠালাম। বিশেষভাবে বলা হচ্ছে, কোন পরিস্থিতিতেই তাদের নাম জানার চেষ্টা করা চলবে না।
  1. 44 11. GH . 43. 07 GH . 45 33 GV . 32 . 13, JZ 54; 05, GR. 47, 55. GR 44, 77, GR, 39, 17, SZ 40, 99, SZ. 38. 66, SZ. 51 . 02. SZ . 47. 21, SZ 48,81,”
ইরগুন জাই লিউমি’হচ্ছে গুপ্ত বিশ্ব ইহুদী গোয়েন্দা চক্রগুলোর একটি। মেসেজ পরিস্কার। ইসরাইলের বিধ্বস্ত স্পাই রিং এর আংশিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা তাতে করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল ডবল ভূমিকায় অভিনয়কারী জাতিসংঘের প্রতিনিধির মুখোশ পরা প্রতিনিধিবর্গ কারা বোঝা যাচ্ছে, GH অর্থাৎ গোলান হাইট, GV অর্থাৎ হুলেহ ভ্যালি, JZ অর্থাৎ  জেজরিস ভ্যালি, GR অর্থাৎ জর্দান রিভার, SZ অর্থাৎ সুয়েজ খাল অঞ্চলে ওরা মোতায়েন আছে। মাহমুদ ভেবে দেখল শুধু রেডিও মিটার দিয়ে ওদের চিহ্নিত করা যাবে না। সুতরাং যে কোন মূল্যেই ওদের নাম জানতে হবে।
মাহমুদ উঠে গিয়ে মিঃ হুগোর একেবারে মুখোমুখি দাঁড়াল। মিঃ হুগোর চোখের মনি দু’টোতে স্থির চক্ষু নিবদ্ধ করে সে বলল, মিঃ হুগো যুদ্ধ বিরতি রেখার ওধারে যারা ইসরাইলের হয়ে কাজ করছে, তাদের নাম বলতে হবে। মিঃ হুগো নীরব। মাহমুদ বলল, অধিবেশনে না বসলে বুঝি কথা বলবেন না।
মিঃ হুগোর চোখ দু’টি চঞ্চল হয়ে উঠল। আশংকার একটি বিষাদ রেখা তার মুখের উপর দিয়ে খেলে গেলে।
মাহমুদ শেখ জামাল কে বলল, পর্দাটা সরিয়ে দাও জামাল। মি হুগো অধিবেশনের ব্যবস্থাটা একটু দেখে নিক।
ঘরে উত্তর দিকে টাঙ্গানো পর্দা সরিয়ে ফেলল জামাল। কাঠের একটি সুদৃঢ় পাটাতন, তাতে চামড়ার ফিতা লাগান। পাটাতনে শায়িত মানুষকে মজবুত করে বাঁধার কাজে তা ব্যবহৃত হয়। পাটাতনের পাশে সুইচবোর্ড। একটি ইলেকট্রিক মেগনেটো পড়ে আছে পাটাতনের উপর, তার উপর সাদা বোতাম জ্বলজ্বল করছে।
মাহমুদ ঐ দিকে অঙ্গুলি সংকেত করে বলল, ঐ তড়িৎ অধিবেশনের সাথে তোমরা তো খুব পরিচিত। আমাদের কথা বলার অভিযানের ওটা প্রথম অস্ত্র। এরপর একে একে আসবে অন্যগুলো।
 মিঃ হুগো একবার চকিত দৃষ্টিতে ওদিকে চেয়ে বলল অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে কি করবে তোমরা, আমি কিছুই জানি না। কণ্ঠ তার কাঁপছে।
ওয়ার্ল্ড পিস ব্রিগ্রেডের লিঁয়াজো অফিসার মিঃ হুগো, জান কি জান না আমরা দেখব। বলে একটু থামল মাহমুদ, তারপর বলল, অমানুষিক নির্যাতন কিন্তু তোমরাই আমাদের শিখিয়েছ। এই সেদিন আলজেরিয়াতে সুসভ্য ইউরোপের তোমাদের জাত ভাইয়েরা কি করল? আলজিয়ার্সের আলবিয়ায় কোয়ার্টার আর ‘সেন্টার দ্য ত্রি’র নির্যাতন কক্ষগুলোতে তোমাদের ভাইয়েরা স্বধীনতাকামী আমাদের ভাইদের উপর কি অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে তা মনে পড়ে নাকি তোমাদের? থামল মাহমুদ। আবার বলল, পাঁচ মিনিট সময় দিলাম তোমাকে, এরমধ্যে যদি নামগুলো বলো তাহলে মুক্তির আশা করতে পারো। এখন তুমি ভেবে দেখ একদিকে মুক্তি অন্য দিকে ভয়াবহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে গমণ – কোনটি তুমি বেছে নেবে।
মাহমুদ বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
মি হুগো গালার্টের স্মৃতিতে নাজি কনসেনট্রেসন ক্যাম্পের ভয়াবহ ঘনাগুলোর কথা জাগরুক রয়েছে। মাহমুদের উল্লেখকৃত আলজিয়ার্সের ‘আলবিয়ার’ ও ‘সেন্টা দ্য ত্রি’র ভয়াবহ নির্যাতন কাহিনীর সাথেও সে পরিচিত। ইলেকট্রিক সিটিং ‘পাটাতন ও ১৫ মেগনেটো’ ‘নকল ডোবনো প্রক্রিয়া, প্রভৃতির কথা স্মরণ হতেই আৎকে উঠল মিঃ হুগো গালার্ট। প্রবল ইচ্ছা শক্তি তার ধ্বসে পড়ে গেল মুহূর্তে।
পাঁচ মিনিট পরে ফিরে এল মাহমুদ। ইলেকট্রিক সিটিংএর আর প্রয়োজন হলো না। তার কাছ থেকে জানা গেল ১৪ টি নাম। লিখে নিল মাহমুদ। তারপর পরখ করে সে দেখল ওপারের যুদ্ধ বিরতি সীমা রেখা তদারককারীদের মধ্যে এসব নাম আছে কিনা।
উঠে দাঁড়িয়ে মাহমুদ বলল, তোমাকে আমরা পাঠিয়ে দেব আমাদের হেড কোয়ার্টারে, ওখান থেকেই তোমার সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে মুক্তি যে এক সময় তুমি পাবে, সে নিশ্চয়তা আমরা তোমাকে দিচ্ছি।
সংগৃহীত নাম ও মেসেজটি হেড কোয়ার্টারে পাঠাবার জন্য মাহমুদ দ্রুত তার মূল ঘাঁটিতে ফিরে এল।
পরদিন বিকেলে লন্ডনের ‘ইভিনিং পোষ্টে’র দু’কলাম হেডিংএর একটি সংবাদ দৃষ্টি আকৃষ্ট করলো মাহমুদের। সিরিয়া, জর্দান ও মিসর সরকার যুদ্ধ বিরতি সীমারেখা তদারককারীদের মধ্যে থেকে গোলান হাইট এলাকার মিকাইল বোরডিন, ক্লারেন্স ডিলোন, বাউন্সকভ, হুলেহ ভ্যালির রলফ বোম্যান, জেজারিল ভ্যালির ফ্রাঙ্ক কার্লসন, জর্দান নদী এলাকার মরিস চাইল্ডস, আর্নল্ড ফোষ্টার, পিটার গাবর এবং সুয়েজ খার এলাকার মিকাইল গার্ডিন, গিল বার্ট গ্রিণ ভিক্টর গ্রুজ, মার্ক গায়েন ও বিল মার্ডোর ২৪ ঘন্টার মধ্যে বহিস্কার দাবী করেছেন। আরব রাষ্ট্রসমূহের স্বার্থবিরোধী কর্ম তৎপরতার অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের প্রতি। প্রশান্ত হাসি ফুটে উঠল মাহমুদের মুখে।
উপরোক্ত খবরের পাশে আর একটি খবরও মাহমুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ইসরাইলের সুপ্রিম নিরাপত্তা কাউন্সিলের মেম্বার ইসরাইল পার্লামেন্টের সদস্য মিঃ সিমসন স্যামুয়েল শালটক সরকারের বিরুদ্ধে আযোগ্যতার অভিযোগ এনেছেন। তিনি বলেছেন, স্যামুয়েল শার্লটক সরকারের অধীনে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে এবং জাতির নিরাপত্তা বিধানকারী সংস্থাগুলো যাচ্ছে রসাতলে। খবরটি পড়ে হাসল মাহমুদ। পতন যখন ঘনিয়ে আসে, তখন সবাই পরস্পর কাদা ছোঁড়াছুড়ি করে নিজেদের দোষ ও অযোগ্যতার কথা ঢেকে রাখতে চায় এবং এইভাবে তারা নিজেদের সংশোধন ও যোগ্যতা বৃদ্ধির পথ বন্ধ করে প্রতিপক্ষের শক্তিবৃদ্ধি ও বিজয়ে সহায়তা করে।


অন্যান্য অধ্যায় পড়তে......
অধ্যায়-৬
অধ্যায়-৪

No comments: