অধ্যায়-৬
গভীর রাত। মাহমুদ তখনো তার টেবিলে বসে।
চারিদিক নিঝুম -নিস্তব্ধ। রাস্তার বিজলি বাতিগুলি চাঁদের আলোয় ফিকে মনে
হচ্ছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। দূরে ভূমধ্যসাগরের জলরাশির উপর
চাঁদের এক মায়া রাজ্যের সৃষ্টি করেছে। মাহমুদ সেদিকে তাকিয়ে আছে ঠিকই
কিন্তু মনে তার চিন্তার ঝড়। সে মনে মনে
‘ওসেয়ান কিং’ জাহাজের দৃশ্যটা
কল্পনা করে নেয়। কাপ্তান কক্ষ, ইঞ্জিন রুম, ফুয়েল ট্যাঙ্ক, বহনকৃত
মালপত্রের সেল, ষ্টাফদের কক্ষ, প্রশস্ত উন্মুক্ত ডেক প্রভৃতি নিয়ে জাহাজ।
জাহাজটি ধ্বংস করার জন্য ফুয়েল ট্যাঙ্কে বিষ্ফোরণ ঘটাতে হবে। ইউরেনিয়াম ও
আণবিক গবেষণার অন্যান্য মাল-মসলা যাতে সরিয়ে নেবার কোন সুযোগ না পায় সেজন্য
সেখানেও দ্রুত আগুন ধরাবার ব্যবস্থা করতে হবে। এবং এসব কাজ অবশ্যই জাহাজে
পৌঁছার পর ভোজ অনুষ্ঠানের আগেই সম্পন্ন করতে হবে। পরিকল্পিত সময়ে
বিষ্ফোরণের জন্য ডেজিচেইনের ব্যবহারই উপযুক্ত বিবেচনা করল সে। ডেজিচেইনের
একপ্রান্তে জুড়ে দেয়া যাবে ডেটানেটর। ডেটোনেটরের সাথে ইচ্ছামত সময়ের টাইম
ইগনেটর ব্যবহার করা যায়। সেফটীপিন তুলে নেবার পর টাইম ইগনেটরে নির্দিষ্ট
সময়ে বিষ্ফোরণ ঘটে থাকে। মাহমুদ চিন্তা করল, ১১টা ভোজ, ১২টা বাজার আগে
নিশ্চয়ই তা শেষ হয়ে যাবে। সোয়া বারটায় বিষ্ফোরণ ঘটাতে চাইলে ২ ঘন্টা সময়ের
টাইম ইগনেটার ব্যবহার করলেই চলতে পারে। কিন্তু সে আবার ভাবল, ডেজিচেইন
পাততে গিয়ে যদি বাধা কিংবা অস্বাভাবিক কিছুর মোকাবিলা করতে হয়, তাহলে
দু’ঘন্টা পর্যন্ত ডেজিচেইন পেতে রাখা নিরাপদ হবে না, কারণ এ সময়ের মধ্যে
অনুসন্ধান হতে পারে এবং ডেজিচেইন
তাদের চোখে পড়ে যেতে পারে।
সুতরাং সিদ্ধান্ত নিল, ১১টা থেকে ১১ -১৫
মিনিটের মধ্যেই বিষ্ফোরণ ঘটাতে হবে। এতে অবশ্য ঝুঁকি আছে। তার এবং এমিলিয়ার
নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে। এ ঝুঁকি তবু নিতে হবে।
‘ওসেয়ান কিং’ জাহাজের ডেকে যখন মাহমুদরা
পা রাখল, তখন ১০টা বেজে ২৯ মিনিট হয়েছে। আজকের এ প্রীতি ভোজ ইসরাইলী
স্বরাষ্ট্র বিভাগ কর্তৃক ইসরাইলী পারমাণু বিজ্ঞানী এবং ইসরাইলের জন্য আণবিক
গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ মালমসলা ও যন্ত্রপাতি বহনকারী ওসেয়ান কিং জাহাজের
ক্যাপটেন ক্রুদের সম্মানে আয়োজিত। অবশ্য এ ভোজ এমিলিয়াদের মত বাছাই করা
কিছু অতিথিদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
জাহাজে উঠবার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ইসরাইলী
স্বরাষ্ট্র বিভাগের একজন উর্ধ্বতন কর্মচারী ও জাহাজের ক্যাপটেন অতিথিদের
সম্ভাষণ জানাচ্ছেন। মাহমুদ ও এমিলিয়া ওদের সাথে করমর্দন করে উপরে উঠে গেল।
মাহমুদ লক্ষ্য করল, স্বরাষ্ট্র বিভাগীয় অফিসার মিঃ গ্রিনবার্জ ও ক্যাপ্টেন
মিঃ আদ্রে সাইমনের পিছনে আর একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি হলেন ইসরাইলী
আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ ‘সিন বেথের’ সহকারী পরিচালক মিঃ হফম্যান।
মাহমুদের ছোঁটের কোণে এক টুকরো বাঁকা হাসি খেলে গেলে।
টেবিল আর চেয়ার দিয়ে সুন্দর করে ডেক
সাজানো হয়েছে। আমন্ত্রিত অতিথিদের অনেকেই এসে গেছেন। কেউ কেউ জাহাজের রেলিং
ধরে দাঁড়িয়ে চন্দ্রালোকিত সাগরের শোভা দেখছেন। আর অবশিষ্টরা ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র দলে বসে জটলা করছেন। মাহমুদ এমিলিয়াকে নিয়ে গোটা ডেকটা একবার চক্কর
দিলো। সশস্ত্র কোন প্রহরীকে উপরে দেখা গেল না। মাহমুদ ভবল, নিশ্চয় তাহলে
ভিতরে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ সময় মাহমুদ লক্ষ্য করল একটি
প্লেটে To Lavatory লিখে জাহাজের অভ্যন্তরে নামবার সিঁড়ির দিকে তীর এঁকে
দেয়া হয়েছে। মাহমুদের মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে এমিলিয়াকে নিয়ে
জাহাজের সামনের প্রান্তে রেলিং এর পার্শ্বস্থিত একটি চেয়ারে এসে বসল। ঘড়ির
দিকে চেয়ে দেখল ১০ টা ৩২ মিনিট বেজে গেছে। মাহমুদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বাথরুম
থেকে একটু আসি।
মাহমুদের পরনে চকলেট সুট। পায়ে ক্রেপসু।
মাহমুদ সিঁড়ি দিয়ে ডেক থেকে নিচে নেমে এল। ভিতরে কিন্তু বাইরের মত উজ্জ্বল
আলো নেই। মাহমুদ সিঁড়ি থেকে নেমে যেখানে এসে দাঁড়াল, সেখান থেকে জাহাজ
লম্বালম্বি দীর্ঘ করিডোর, দু’পাশে কেবিন-কার্গো কেবিন। মাহমুদ করিডোরে
দাঁড়াতেই একজন ষ্টেনগানধারী প্রহরী মাহমেুদকে জিজ্ঞাসা করল -ল্যাভেটরী
স্যার?
-হাঁ। মাহমুদ বলল।
-আসুন। বামে কয়েক পা এগিয়ে একটি বন্ধ ঘর
দেখিয়ে দিল। মাহমুদ হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলল। তারপর পিছন ফিরে দেখল, প্রহরীটি
পিছন ফিরে কয়েক পা এগিয়েছে। মাহমুদ দেখল, করিডোরে আর কেউ নেই। তারপর পকেট
থেকে একটি রুমাল ও শিশি বের করে বিড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে প্রহরীর দেক এগুতে
লাগল। নিকটবর্তী হয়ে অত্যন্ত দ্রুত বাম হাত দিয়ে লোকটির কন্ঠনালি চেপে
ধরল, অন্য হাতে ক্লোরোফরম সিক্ত রুমালটি লোকটির নাকে চেপে রাখল। কয়েকবার
কোক কোক শব্দ করার পর তার দেহটি নিস্তেজ হয়ে এল। ষ্টেনগানটি হাত থেকে পড়ে
গিয়ে ঠক করে একটি শব্দ হল। মাহমুদ তার দেহটি টেনে নিয়ে গিয়ে ল্যাভেটরী ও
কার্গো কেবিনের মাঝের সরু গলির মধ্যে রেখে দিল। স্থানটি একটু অন্ধকার।
সেখানে একটি সোফাও দেখল মাহমুদ। বুঝল প্রহরীরা এখানে বসে বিশ্রাম নেয়।
মাহমুদের হাতে সাইলেন্সার লাগানো নিভলবার।
মাহমুদ ইঞ্জিন রুমের সিঁড়িতে পা রাখতে যাবে, এমন সময় পেছন থেকে শব্দ ভেসে
এল, ‘হ্যাঁন্ডস আপ’।
মাহমুদ হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়ল। মাহমুদ
তার পিঠে রিভলভারের ভারী স্পর্শ অনুভব করল। মাহমুদ আশু কর্তব্য ভেবে নিল,
তারপর এক ঝটকায় বসে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গেই পিছনে দাঁড়ানো লোকটির দু’টি পা
ধরে সামনে মারল হেচকা টান। লোকটি কাত হয়ে পড়ে গেল। রিভলভার ও ছিটকে গেল
তার হাত থেকে। বজ্র মুষ্টিতে চেপে ধরল কণ্ঠনালি। মাত্র কয়েক মুহূর্ত। তারপর
নিস্তেজ হয়ে এলো লোকটির দেহ। মাহমুদ তাড়াতাড়ি লোকটিকে টেনে এনে ইঞ্জিন
রুমের এক কোণে গুঁজে রেখে দিল। লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে মাহমুদ চমকে উঠল।
একি? মিঃ হফম্যান? উজ্জ্বল হাসিতে মাহমুদের মুখ ভরে গেল। অগণিত মুসলিম
বাস্ত্তত্যাগী আর বহু সাইমুম কর্মীর রক্তে রঞ্জিত ইসরাইলী গোয়েন্দা এই
হফম্যানের হাত। এতদিনে সব লীলা অবসান হলো শয়তানের।
মাহমুদ দ্রুত ইঞ্জিন রুমের পাশ দিয়ে
জ্বালানি সঞ্চয় কক্ষে প্রবেশ করল এবং দ্রুত কাজে লেগে গেল। তিনটি বৃহদাকার
ট্যাঙ্ক। সৌভাগ্যক্রমে ট্যাঙ্কগুলি ঈষৎ উঁচু সারিবদ্ধ কতগুলি ইস্পাত বেজের
উপর রাখা। মাহমুদ দ্রুত ডেজিচেইন পেতে তার মাথায় ডেটোনেটর ও টাইম ইগনেটর
জুড়ে দিল। প্রত্যেকটি ট্যাঙ্কের জন্য দু’টি করে ডেজিচেইন পাতল মাহমুদ।
তারপর ফিরে এল আবার ইঞ্জিন রুমে। সেখান থেকে উঠে এর পূর্বের করিডোরে।
করিডোরে কেউ নেই। মাহমুদ বুঝল প্রহরী ও জাহাজের ক্রুরা সবাই নিশ্চিন্তে ভোজ
সভার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে। মাহমুদ কার্গো কেবিনে ডেজিচেইন পাতার বিষয়
বিবেচনা করে দেখল। কিন্তু এর প্রয়োজন হবে বলে মনে হলো না মাহমুদের।
এবার নিশ্চিন্ত হয়ে সে প্রবেশ করল
ল্যাভেটরীতে। বেশ করে হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এল সেখান থেকে। ঘড়ির দিকে চেয়ে
দেখল ১০ টা বেজে ৪৭ মিনিট। মাহমুদ ভবল, এমিলিয়া নিশ্চয় এই দেরীতে উদ্বিগ্ন
হয়ে উঠেছে।
মাহমুদ সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল। সোজাসুজি
এমিলিয়ার কাছে না গিয়ে রেলিং এর ধারে গিয়ে দাঁড়াল। সে লক্ষ্য করল, সে এখনো
এমিলিয়ার দৃষ্টিতে পড়েনি।
সাগরে চাঁদের স্থির প্রতিবিম্বের দিকে এক
দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহমুদ। স্থির চাঁদের ঐ আলোক শিখা মাহমুদের মনকে টেনে
নিয়ে গেল জর্দানের পাহাড় আর তার পাশ্বের উপত্যকা ভূমিতে। সেখানে তাঁবু আর
কুঁড়ে ঘরে বাস করছে অগণিত মানুষ – মজলুম মানুষ। ঐ মজলুম মুসলমানদের জন্য
আমরা এ পর্যন্ত কি করতে পেরেছি? সময় যতই গেছে ইসরাইল তার বিষাক্ত থাবাকে
আরও সুদৃঢ়, আরও সুবিস্তৃত করেছে। এমিলিয়া এসে মাহমুদের পাশে দাঁড়াল।
মাহমুদের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলল, কি স্বপ্ন দেখছ?
মাহমুদ চমকে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই মুখে
ফুটিয়ে তুলল মৃদু হাসির রেখা। বলল, ভাবছি এই সাগর আর এ তারকা খচিত নিকষ
কালো আকাশের অসীমত্বের কথা। আমরা কত ক্ষুদ্র। এই সাগর ঐ অসীম আকাশ আর এই
বিচিত্র পৃথিবীর মালিক স্রষ্টা না জানি কত মহাশক্তিশালী। শান্ত ও
অনুচ্চস্বরে বলল স্রষ্টাকে তুমি মহাশক্তিশালী মনে কর দানিয়েল?
-আমার স্বীকার করা বা না করার সাথে এর
সম্বন্ধ নেই এমিলিয়া। মহা সৃষ্টির মাইে যে তার মহাশক্তির সাক্ষ্য নিহিত।
স্রষ্টাকে তুমি অস্বীকার করতে পারো এমিলিয়া?
-কিন্তু স্রষ্টাকে মানতে গেলে ধর্মকে মানতে হয়। আর ধর্মকে মানতে গেলে দেখ না কত ফ্যাসাদ।
-যেমন?
-কোন ধর্ম মানবো, ইহুদী না খৃষ্টান, না মোহামেডান? এত সংঘর্ষ আর বৈপরীত্য কেন?
-বৈপরীত্য নেই এমিলিয়া। মুসা, যিশু খৃষ্ট
আর মোহাম্মদ এর মূল শিক্ষা একই। ব্যবহারিক ক্রিয়া কর্মের মধ্যে পার্থক্য
আছে শুধু এই পার্থক্যকে শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন ও সংশোধনের সাথে তুলনা করা
যায়।
-কিন্তু এটা স্বীকার করে নিলে যে ইসলামকে মানব সমাজের জন্য শেষ ও অনুসরণীয় একমাত্র জীবন বিধান বলে মেনে নিতে হয়?
-কিন্তু যা সত্য, তাকে আমরা অস্বীকার করব কেমন করে?
-এটা গুরুতর কথা দানিয়েল? এত সহজে এমন কথা তুমি বলতে পার না। যাক। আজ ধর্মের কি সত্যই কোন প্রয়োজন আছে বলে তুমি মনে কর?
-ধর্মের অর্থ জীবন পদ্ধতি। সুতরাং এ ভূমন্ডলে মানুষের জীবন যত দিন থাকবে ধর্মের প্রয়োজনও ততদিন থাকবে।
-জীবন পদ্ধতি আমরা নিজেরাই গড়ে নিতে পারি।
-তা পারি। এ ধরনের জীবন পদ্ধতি ফেরাউন,
নমরুদ, সাদ্দাদ গড়ে তুলেছিল। প্লেটো, রুশো, ভল্টেয়ার মানুষের জন্য নতুন
জীবন পদ্ধতির দিক নির্দেশ করেছিল। হেগেল, কার্ল মার্কস মানব সমাজের জন্য
ঐতিহাসিক বস্ত্তবাদের আলোকে নতুন জীবনদর্শনের রূপরেখা এঁকে গেছে এবং সে
মোতাবেক লেনিন, মাওসেতুং এর নেতৃত্বে রাশিয়া ও চীনে সর্বাত্মক বিপ্লবও
সাধিত হয়েছে। গণতন্ত্রের উপর ভিত্তিশীল এক নয়া সমাজ পদ্ধতি (অবশ্য প্রকৃত
পক্ষে এটা প্রাচীন গ্রীসিয় সমাজ সভ্যতার নবতর সংস্করণ) পশ্চিমা দেশগুলোতে
চালু আছে কিন্তু এগুলোর কোন একটিও কি রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে
শান্তির সন্ধান দিতে পেরেছে? শ্রেণী স্বার্থের ধ্বজা তুলে সাম্যবাদের নামে
সমাজবাদী দেশগুলো কি জনতাকে দাসে পরিণত করেনি? আর পুঁজিবাদী দেশগুলোতে
ব্যক্তিস্বার্থ ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে লুণ্ঠন শোষণের অবাধ সয়লাব কি বয়ে
যাচ্ছে না? অশান্ত অস্থির মানুষকে ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমোতে হয় কোন কারণে?
-কিন্তু স্রষ্টার নির্দেশিত জীবন পদ্ধতি সব সমস্যার সমাধান করবে, তার নিশ্চয়তা কি?
-আচ্ছা এমিলিয়া সাপের কোন জিনিসকে আমরা ভয় করি?
-বিষ দাঁতকে?
-আচ্ছা সাপের বিষ দাঁতকে যদি উপড়ে ফেলা হয়, তাহলে সে আর কোন ক্ষতি করতে পারে কি?
-না পারে না। এমিলিয়া হাসল। বলল, কিন্তু মানুষের বিষদাঁত তুমি পাবে কোথায়?
-মানুষের বিষদাঁত তার স্বেচ্ছাচারিতা ও
স্বার্থপরতা। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনে সকল প্রকার বিপর্যয়, অশান্তি ও
অনর্থের মূল কারণ মানুষের স্বার্থপরতা ও স্বেচ্ছাচারিতা। স্বার্থপরতা
অন্যায়ের বাহন আর স্বেচ্ছাচারিতা তার অমোঘ অস্ত্র।
-কিন্তু এ বিষদাঁতকে তো ভাঙ্গা যায় না।
-ভাঙ্গা যায় না, কিন্তু এর বিলুপ্তি ঘটানো
সম্ভব। মানুষ যখন এক স্রষ্টার সার্বভৌম ক্ষমতার কাছে সত্যিকার ভাবে মাথা
নত করে তখন তার স্বেচ্চাচারিতা ও স্বার্থপরতার কোন সুযোগই আর থাকে না। সে
সত্যিকারভাবে তখন স্রস্টার দেয়া বিধানবলীর প্রতিপালণকারী ও প্রয়োগকারী হয়ে
দাঁড়ায়।
এমিলিয়া এক দৃষ্টিতে মাহমুদের দিকে তাকিয়ে
ছিল। তার মুগ্ধ দৃষ্টি যেন আনন্দে নাচছে। সে বলল, আমার দেখা, আমার পরিচিত
জনস্রোতের মাঝে তুমি সত্যই ব্যতিক্রম দানিয়েল। তুমি কখনো কঠিন বস্তুবাদী
আবার কখনো কঠোর ভাববাদী। তুমি আসলে কি দানিয়েল?
-আমি একজন মানুষ। হাসল মাহমুদ।
এমিলিয়াও হাসল। কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমন
সময় ক্ষুদ্রকার ডেকমাইক থেকে ঘোষিত হল, লেডিজ এন্ড জেন্টলম্যান আপনাদের স্ব
স্ব আসন গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।
সবাই গিয়ে আসন গ্রহণ করল। মাহমুদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত এগারটা বাজতে এক মিনিট বাকী।
রাত ১১ টা বেজে গেছে। আজকের অনুষ্ঠানের
প্রধান অতিথি ইসরাইলের বিজ্ঞান ও কারিগরি মন্ত্রী এ্যারোন কোপল্যান্ড তার
আসন গ্রহণ করেছেন। ১১ টা বাজার সাথে সাথে ইসরাইলী অণুবিজ্ঞানী মিঃ মরিস
কোহেন এবং মিঃ মোসে সারটক এসে আসন গ্রহণ করলেন।
১১ টা ১ মিনিট বাজল। মিঃ এ্যারোন
কোপল্যান্ড উঠে দাঁড়ালেন উপস্থিত আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের দিকে চোখ বুলিয়ে
নিয়ে বললেন, উপস্থিত ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, আজ আমাদের জন্য এক পরম খুশীর
দিন। আমাদের পিতৃভূমি ইসরাইল এক নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। আমাদের
সমরশক্তিতে পরমাণু বিজ্ঞানের আশির্বাদ লাভের জন্য আমরা এতদিন পরের
অনুগ্রহের উপর নির্ভর করেছি। আমাদের বিজ্ঞান ও আমাদের কারিগররা পারমাণবিক
কৌশল আয়ত্ব করেছে অনেক আগে, কিন্তু নিজস্ব গবেষণাগার স্থাপনের কোন সুযোগ
আমরা পাইনি। এতদিনে সে সুযোগ আমরা লাভ করতে যাচ্ছি। সুতরাং আজকের এদিন
আমাদের বিজ্ঞানী, আমাদের জনসাধারণ, আমাদের সরকার এবং আমাদের বিদেশের
শুভানুধ্যায়ীদের জন্য মহা আনন্দের সওগাত বয়ে এনেছে। আমরা এ নিশ্চয়তা আজ
সবাইকে দিতে পারি সেদিন বেশী দূরে নয়, যেদিন আমরা আমেরিকা ও রাশিয়ার মত
ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেষ্টিক মিসাইলের অধিকারী হবো।
শ্রোতমন্ডলি করতালি দিলেন। একটু থেমে
মন্ত্রী মহোদয় আবার শুরু করলেন, পিতৃভূমির যে অংশটুকুর উপর আমরা অধিকার লাভ
করেছি, তা নিয়ে আমরা কেউই সন্তুষ্ট নই, সন্তুষ্ট থাকতে পারি না। হেজাযের
ইয়াসরেব নগরী ( আল মদিনা ) থেকে তুরস্কের আলেকজান্দ্রিয়া প্রদেশ এবং
ভূমধ্যসাগর ও নীল নদের সীমা থেকে ইউফ্রেটিস-তাইগ্রিস নদীর মোহনা পর্যন্ত
বিস্তৃত আমাদের পিতৃভূমির উপর আমরা যে কোন মূল্যেই হোক অধিকার কায়েম করবো।
এজন্য চাই আরো শক্তি – আরো শক্তি ( আবার তুমূল করতালি কিন্তু মাহমুদের হাত
দু’টিই শুধু নড়ল না )।
১১ টা ৭ মিঃ অনুষ্ঠানে শেষ হলো। খাবার
প্রস্ত্ততি শুরু হল। সবাই নিজের কোলের উপর রুমাল বিছিয়ে নিচ্ছেন। মাহমুদের
মন চঞ্চল হয়ে উঠল। আর তিন মিনিটের মধ্যেই প্রথম বিষ্ফোরণ ঘটার কথা। আল্লাহ
কি দয়া করবেন? তার মিশন কি সফল হবে। বলদর্পী সাম্রাজ্যবাদী রক্ত পিপাসু
ইহুদীদের আশার এ দীপশিখাকে কি সে নিভিয়ে দিতে পারবে? সকলের সামনে স্যুপ
পরিবেশিত হয়েছে। চামচ দিয়ে স্যুপ নাড়ছে সবাই। চামচ দিয়ে ধীরে ধীরে মুখে
তুলছে স্যুপ। সবার মত মাহমুদের মুখেও স্যুপ উঠছে। কিন্তু তার মন আশা
নিরাশার তরঙ্গঘাতে অশান্ত চঞ্চল। ১১ টা ৯ মিঃ ৩০ সেকেন্ড। জাহাজ
প্রচন্ডভাবে কেঁপে উঠল। প্রচণ্ড বিষ্ফোরণের শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে এক বিরাট
অগ্নিপিন্ড আকাশের দিকে উঠে গেল। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল খাবার টেবিলে। স্যুপের
পিয়ালা অনেকের কাত হয়ে পড়ে গেছে ইতিমধ্যেই। সবাই উঠে দাড়িয়েছে। ভীত
আতঙ্কগ্রস্থ সবাই। মাহমুদ তার কর্তব্য আগেই ঠিক করে রেখেছিল। এমিলিয়াকে
বলল, এস আমার সাথে। বলে সে ছুটলো ডেক থেকে জেটিতে নামবার সিঁড়ির দিকে।
জাহাজ কাঁপছে। প্রথম বিষ্ফারণের ফলে উৎক্ষিপ্ত অগ্নিপিন্ড নিচে নেমে জাহাজে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। সিঁড়ির মুখে গিয়ে মাহমুদ এমিলিয়াকে বলল, হাত দিয়ে গলা
জড়িয়ে ধরে আমার পিঠে উঠ।
এমিলিয়ার মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে
কাঁপছে। মাহমুদের আদেশ পালন করল সে। অভ্যস্ত মাহমুদ দ্রুত কম্পমান সিঁড়ি
দিয়ে জেটিতে নেমে এল। জেটিতে পা রাখার সাথে সাথে আর একটি বিষ্ফারণের শব্দ
হল। মাহমুদ পিছনে ফিরে দেখল, জাহাজের বিজলি বাতি নিভে গেছে। কিন্তু
বিষ্ফোরণের ফলে উৎক্ষিপ্ত আগুন জাহাজকে আলোকিত করে তুলছে। সেই আলোতে দেখা
গেল জাহাজের একটা অংশ সম্পূর্ণ উড়ে গেছে। দ্বিতীয় বিষ্ফোরণের অগ্নিপিন্ড
জাহাজে ছড়িয়ে পড়ায় জাহাজের স্থানে স্থানে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। মাহমুদ
এমিলিয়াকে নিয়ে জেটি থেকে আর একটু দূরে সরে এল। মাহমুদ দেখল আরো কয়েকজন
মানুষ সিঁড়ি দিয়ে জেটিতে নেমে এল। আর একটি বিষ্ফোরণ ঘটল এ সময়। মনে হল
জাহাজটি যেন একদিকে কাত হয়ে গেল। অপেক্ষকৃত ছোট আরও অনেকগুলি বিষ্ফোরণের
শব্দ শোনা গেল। জাহাজের অন্যান্য কয়েক স্থান থেকেও আগুনের লেলিহান শিখা
দেখা যেতে লাগল। দূরে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ীর ঘন্টাধ্বনি শোনা গেল। মাহমুদ ও
এমিলিয়া গাড়ীতে গিয়ে বসল। মাহমুদ গাড়ি ছেড়ে দিল। পোর্ট রোড ধরে গাড়ী তীব্র
গতিতে পূর্বদিকে এগিয়ে চলছে। তেলআবিব অনেক দূরের পথ। লম্বা রাস্তা।
মাহমুদের দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পেরে
তার মন তৃপ্ত। এ তৃপ্তির মাঝেও তার মনে একটি কাঁটা বিধছে। এবার এমিলিয়ার
সাথে তার অভিনয়ের ইতি করতে হবে। কিন্তু শুধুই কি তা অভিনয় ছিল? মনের কোথায়
যেন বেদানার সুর বাজছে তার। এমিলিয়া তার পরিচয় পেলে কি ভাববে তাকে? কালকেই
গোয়েন্দা পুলিশ এসে এমিলিয়াকে ব্যস্ত করে তুলবে। বিনা অপরাধে বেচারী কষ্ট
পাবে। এমিলিয়া একটু কাত হয়ে একটি হাত মাহমুদের পিছনে সোফার উপর প্রসারিত
করে একটি হাত মাহমুদের কাঁধে রেখে মুখটি মাহমুদের কাঁধে গুঁজে রেখেছে। এক
সময় ধীর কন্ঠে সে বলল, দানিয়েল, একবার তুমি আমাকে নৈতিক মৃত্যু থেকে
বাঁচিয়েছ, আবার আজ তুমি আমাকে দৈহিক মৃত্যুর হাত তেকে বাঁচালে। জীবন দিয়েও এ
ঋণ শোধ করতে পারব না আমি দানিয়েল। মাহমুদের গোটা দেহে একটি শিহরণ খেলে
গেল। কিন্তু কোন উত্তর দিল না মাহমুদ। কি উত্তর দেবে সে? যে তার জীবনকে
জাতির জন্য উৎসর্গ করেছে, সে কেমন করে একজন ইহুদী তরুণীর এ আত্ম নিবেদনকে
গ্রহণ করবে? মাহমুদ ধীরে ধীরে বলল, কাল সকালে পুলিশ আসবে। আমার সম্বন্ধে
জিজ্ঞেস করবে তারা। কি জবাব দিবে তুমি?
-কেন পুলিশ আসবে?
-আসবে।
-কেন আসবে?
-ধর যদি আসেই?
-আমি তোমার ঠিকানা বলে দেব, তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব।
-পুলিশ আমাকে খুঁজে পাবে না।
-কেন? কোথাও চলে যাচ্ছ তুমি? বলে সোজা হয়ে
বসল এমিলিয়া। মাহমুদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর এমিলিয়ার প্রশ্নের কোন
জবাব না দিয়েই বলল, পুলিশকে আমাদের পরিচয়ের আসল ঘটনাটির কথা জানাবে তাহলে
আমাদের বন্ধুত্বের কারণ তারা বুঝবে এবং তোমার কোন দোষ হবে না।
-পুলিশ কেন তোমার সন্ধান করবে? কেন দোষ দিবে আমাকে তারা? এমিলিয়ার কন্ঠে উদ্বগ।
-ওসেয়ান কিং’ জাহাজ ধ্বংসের জন্য আমাকেই দায়ী করবে তারা।
-কেন তা করবে? তুমি ও কাজ করতে যাবে কোন
কারণে? মাহমুদ মুহূর্তের জন্য এমিলিয়ার মুখের দিকে তাকাল। তার লাবণ্যভরা
মুখটি উদ্বিগ উত্তেজনায় যেন কাঁপছে। ওর কোমল হৃদয়ে আঘাত দিতে কষ্ট লাগছে
মাহমুদের। তবু সত্য ঘটনা তাকে বলতেই হবে মাহমুদ গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘ওসেয়ান
কিং’ জাহাজের ফুয়েল ট্যাংকে আমি বিষ্ফোরণ ঘটিয়েছি এমিলিয়া।
-তুমি? এমিলিয়ার কণ্ঠ আর্ত চিৎকারের মত
শোনাল। বিস্ময় উত্তেজনায় এমিলিয়ার মুখ হা হয়ে গেছে। সে বির্বাক দৃষ্টিতে
আকিয়ে আছে মাহমুদের দিকে।
-মাহমুদ আবার এমিলিয়ার দিকে চাইল। তার
মুখে ফুটে উঠল হাসির রেখা। কিন্তু তা যেন তাসি নয়, কান্না। বলল, জানি
এমিলিয়া তুমি বিস্মিত হয়েছ। হয়তো ভাবছও আমি কেমন করে অমন খুনী হতে পারলাম।
কিন্তু তুমি জান না, ‘ওসেয়ান কিং’ জাহাজে যে অগ্নিকুন্ড তুমি দেখেছ, তার
চেয়েও অনেক বড় অগ্নিকুন্ড আমার হৃদয়ে জ্বলছে। শুধু আমার হৃদয়ে নয়,
ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত আমার মত লক্ষ লক্ষ আরব মুসলমানের হৃদয়ে এ আগুন অমনি
জ্বলছে।
-তুমি আরব? তুমি মুসলমান? এমিলিয়ার কণ্ঠ আর্তনাদ করে উঠল।
-হাঁ এমিলিয়া, আমি মুসলমান।
-বিস্ময় বিষ্ফারিত এমিলিয়ার চোখ। গভীর
বেদনায় শক্ত নীল হয়ে উঠেছে এমিলিয়ার শুভ্র গন্ডদেশ। গোলাপের মত ঠোঁট দু’টি
তার কাঁপছে। বিহ্ব্ল দৃষ্টিতে মুহূর্ত কাল মাহমুদের দিকে চেয়ে থাকল। তারপর
ভেঙ্গে পড়ল কান্নায়। উপুড় হয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে
সে। মাহমুদের দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। জন বিরল প্রশস্ত রাস্তা। তীব্র গতিতে
এগিয়ে চলেছে কার্ডিয়াক। মাহমুদ এবার এমিলিয়ার দিকে চাইল, কাঁদুক, কাঁদা
উচিত। চোখের পানিতে ধুয়ে মুছে যাক মাহমুদে সব স্মৃতি।
খোলা প্রশস্ত গেট দিয়ে ডেভিড বেনগুরিয়ানের
বারান্দায় প্রবেশ করল গাড়ী। মাহমুদ গাড়ী থেকে নেমে পাশ ঘুরে এসে গাড়ীর
দরজা খুলে ধরে বলল, নেমে এস। এমিলিয়া মুখ তুলল। অশ্রু ধোয়া মুখ তার।
দু’একটি অবিন্যস্ত চুল মুখে এসে পড়েছে। অশ্রুতে ভিজে গেছে সে গুলোও। কঠিন
আঘাতে যে চোখে অশ্রু আসে না, মাহমুদের সে চোখ দু’টিও ভারী হয়ে উঠল। এমিলিয়া
বেরিয়ে এসে মাহমুদের পাশে দাঁড়াল। নতমুখী এমিলিয়া। দু’জনই নির্বাক। প্রথমে
কথা বলল মাহমুদ। বলল, পরিচয় গোপন করার জন্য এবং তোমাকে এমন করে আঘাত দেয়ার
জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী এমিলিয়া। তুমি যদি আমাকে ভুল না বুঝ, তাহলে আমাকে
ক্ষমা তুমি করতে পারবে।
এমিলিয়া নীরব। কোন কথা বলল না। মুখও তুলল না সে।
মাহমুদ আবার বলল, আর যদি প্রতিশোধ নিতে চাও তাহলে আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দাও। আমি রাজী আছি।
এমিলিয়া যেন পাথর হয়ে গেছে। কোন উত্তর এল
না তার কাছে থেকে। যেন অলক্ষ্যে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মাহমুদের বুক
থেকে চোখের কোণও বোধ হয় ভিজে এল তার বলল সে, তাহলে আসি এমিলিয়া, পারলে
ক্ষমা করো।
দু’হাত মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল এমিলিয়া। মাহমুদ কয়েক পা এগিয়ে ছিল। ফিরে এল আবার। এমিলিয়ার মুখ তুলে ধরে ডাকল এমিলিয়া।
-দানিয়েল। বলে মাহমুদের হাত জড়িয়ে ধরে বাঁধ ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল এমিলিয়া।
আর দানিয়েল নায় এমিলিয়া। আমার নাম মাহমুদ। ধীর স্বরে বলল মাহমুদ।
এমিলিয়া কেঁদেই চলল। মাহমুদের হাত এমিলিয়ার চোখের পানিতে ভিজে গেল।
মাহমুদ বলল, মুখ তোল কথা বল এমিলিয়া।
এমিলিয়া ধীরে ধীরে মুখ তুলল। অবিন্যস্ত
চুল আর অশ্রু ধোয়া এমিলিয়াকে দেখে মনে হচ্ছে, কি এক প্রচন্ড ঝড় বয়ে গেছে
এমিলিয়ার উপর দিয়ে। তার নীল শান্ত চোখে কি নিঃসীম মায়া বলল সে, আবার কবে
দেখা হবে?
শক্ত একটি প্রশ্ন। মাহমুদ বলতে চাইল।
স্রোতে ভাসা পানার মত নিরুদ্দিষ্ট আমাদের জীবন। কোন আবর্ত কোথায় কখন আমাদের
নিয়ে যাবে তা আমরাও জানি না। কিন্তু কথা বাড়াতে চাইল না মাহমুদ। বলল, যদি
কোথাও দূরে চলে না যাই তাহলে দেখা হবে।
-আর যদি দূরে চলে যাও? অবরুদ্ধ কান্নায় কাঁপতে লাগল এমিলিয়ার ঠোঁট দু’টি।
-একটি যাযাবর জীবনের জন্য তুমি অপেক্ষা করবে এমিলিয়া?
এমিলিয়ার দুই গন্ড বেয়ে আবার নেমে এল অশ্রুর দু’টি ধারা। বলল সে, কোন কথা নয় কথা দাও তুমি আসবে?
-কথা দিলাম আসব।
-বেশ। বলে এমিলিয়া মাহমুদের হাত ছেড়ে দিয়ে
বলল, এ সময় এ অঞ্চলে কোন ট্যাক্সি পাবে না, হেঁটে যাবে কেমন করে? চল আমি
তোমাকে রেখে আসব। মাহমুদ ম্লান হাসল। বলল, এতক্ষণ তোমাদের গোয়েন্দারা হয়ত
আমার সন্ধানে ছুটে আসছে। তোমাকে আর কোন বিপদে জড়াতে চাই না এমিলিয়া।
-কিন্তু তোমার বিপদের কথা তুমি ভাবছ না কেন?
-বিপদ আমাদের নিত্য খেলার সাথী। কোন
চিন্তা করো না তুমি। আর আমাকে হেঁটে যেতে হচ্ছে না, তোমাদের গেটের বাইরে
আমার জন্য গাড়ী অপেক্ষা করছে। বলে মাহমুদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, আসি
এমিলিয়া। খোদা হাফেজ।
-আচ্ছা এস। কম্পিত কন্ঠে বলল এমিলিয়া।
মাহমুদ কয়েক কদম এগিয়ে আবার পিছনে ফিরে
চাইল। দেখল, এমিলিয়া একটি হাত গাড়ীর উপর ঠেস দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
গাড়ি বারান্দায় ম্লান আলো তার চোখের পানিতে প্রতিবিম্বত হয়ে চিক চিক করছে।
হৃদয়ের কোথায় যেন মোচড় দিয়ে উঠল মাহমুদের। তার যাত্রা পথের দিকে চোখ দু’টি
বুজে এল মাহমুদের। উচ্চারিত হল তার কন্ঠেঃ রাববানা আজআলনা মুসলিমাইনিলাকা
(প্রভু আমার, তোমার কাছে আত্মসমর্পণকারী মুসলমানদের মধ্যে আমাদের সামিল
কর)।
পরদিন সকালে অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠল
এমিলিয়া। অনেক রাত্রে ঘুমিয়েছে সে। রাত্রেই এসেছিল নিরাপত্তা পুলিশরা। নাইট
ক্লাবের মৌখিক পরিচয় ছাড়া মাহমুদ সম্বন্ধে আর কোন কিছু্ই জানে না বলেই
জানিয়েছে এমিলিয়া তাঁদের। এমিলিয়ার বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই
বলেই তার হয়ত কোন পীড়াপীড়ি করেনি আর।
শয্যায় উঠে বসেই সে দেখতে পেল পাশের টিপয়ে
রাখা সেদিনের সংবাদপত্র। কাগজটি হাতে নিয়ে চোখ বুলোতেই সে দেখতে পেল,
ওসেয়ান কিং জাহাজের খবরটি লিড ষ্টোরি হয়েছে। সে পড়ল, ওসেয়ান কিং জাহাজের
ভয়াবহ অগ্নিকান্ডঃ
অণূ বিজ্ঞানী মিঃ মরিস কোগেনসহ পাঁচজনের মৃত্যুঃ
২ জন নিখোঁজঃ ১০ জন আহতঃ সমুদয় কার্গো
ভস্মিভূত। পরে ওসেয়ান কিং জাহাজে অগ্নিকান্ডের সময় ও পূর্ণ বিবরণ দিয়ে
পরিশেষে লিখেছে ‘‘এই অগ্নিকান্ডে ইসরাইলের ৫০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের মহা
মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও মালপত্র সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতি অণূ
বিজ্ঞানী মিঃ মরিস কোহেনের মৃত্যু। তিনি ইসরাইল বিজ্ঞানাকাশের সূর্য এবং
আমাদের জাতীয় জীবনের এক অমূল্য রত্ন ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে পরমাণু বিজ্ঞানে
আমাদের দেশ যে অনেক দূর পিছিয়ে গেল, তা বলাই বাহুল্য। এক বিশ্বস্ত সূত্রে
প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে যে ওসেয়ান কিং জাহাজে ৫০ মিলিয়ন ডলারের পারমাণবিক
গবেষণা সরঞ্জাম বোঝাই ছিল। এই মহামূল্যবান গবেষণা সরঞ্জামের বিনষ্টি আমাদের
জাতীয় অগ্রগতির জন্য কত মর্মান্তিক, তা সহজেই অনুমেয়। ওসেয়ান কিং জাহাজের
ঘটনায় নিহতদের মধ্যে আরো রয়েছেন, জাহাজের ক্যাপটেন জন টমসন এবং
নিরুদ্দিষ্টদের মধ্যে আরো রয়েছে ইসরাইলী গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী প্রধান
মিঃ হফম্যান। জানা গেছে, ভোজ অনুষ্ঠানের কিছু পূর্বে থেকেই তাঁকে জাহাজের
ডেকে দেখা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে যে, দুষ্কৃতিকারীদের সাথে সংঘর্ষে তিনি
নিহত হয়েছেন।
সাইমুদের নাশকতাকারীরা জাহাজের ফুয়েল
ট্যাংকে বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে জাহাজে আগুন ধরিয়েছে বলে জানা গেছে, সংগৃহীত তথ্যের
বরাত দিয়ে আমাদের নিরাপত্তা পুলিশ বিভাগ জানাচ্ছেন, আমন্ত্রিত অতিথির
ছদ্মবেশে সাইমুমের জনৈক নাশকাতাকারী জাহাজে প্রবেশ করেছিলো।’’
এমিলিয়া রুদ্ধ নিঃশ্বাসে খবর পড়া শেষ করল।
বৈজ্ঞানিক মিঃ মরিস কোহেন এবং মি হফম্যানের মৃত্যু হয়েছে? এমিলিয়ার
স্নায়ুতন্ত্রী দিয়ে এক হিম শীতল স্রোত বয়ে গেল। কি নিষ্ঠুরতা? কিন্তু
পরক্ষনেই তার মানস দৃষ্টিতে ভেসে উঠল মাহমুদের মুখ আর তার কথাঃ ‘‘এমিলিয়া
তুমি জান না, ওসেয়ান কিং জাহাজে যে অগ্নিকান্ড তুমি দেখেছ, তার চেয়েও অনেক
বড় অগ্নিকুন্ড আমার হৃদয়ে জ্বলছে। শুধু আমার হৃদয়ে নয় ফিলিস্তিন থেকে
বিতাড়িত লক্ষ লক্ষ আরব মুসলমানদের হৃদয়ে এ আগুন এমনিভাবে জ্বলছে।’’
এমিলিয়ার মনে পড়ল, তাইতো আমরা ইহুদীরা বিভিন্ন দেশ থেকে এসে ফিলিস্তিনী
মুসলমানদের সহায় সম্পদ দখল করেছি, তাদেরকে তাদের পিতৃ পুরুষের ভিটা বাড়ী
থেকে উচ্ছেদ করেছি। আর যুগ যুগ ধরে মুক্ত আকাশের নীচে বৃষ্টি রোদের মধ্যে
তাবুতে অমানুষিক জীবন যাপন করছে তারা। এমিলিয়ার আরো মনে পড়ল হত কালকের
ভোজসভার বিজ্ঞান বিষয়ক মন্ত্রী মিঃ এ্যারোন কোপল্যাডের ভাষণঃ ‘হেযাজের
ইয়সবরিব নগরী (মদিনা শরিফ) থেকে তুরস্কের আলেকজান্দ্রিয়া প্রদেশ এবং
ভূমধ্যসাগর ও নীলনদের মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত আমাদের পিতৃভূমির উপর আমরা যে
কোন মূল্যেই হোক অধিকার কায়েম করব।’’ ইসরাইলের এ ঘোষণা এ লক্ষ্যতো কোন
আত্মরক্ষাকারী জাতি বা দেশের কথা নয়। এ যে সাম্রাজ্যবাদী দেশের আগ্রাসী
নীতি। এ লক্ষ্য যদি অর্জিত হয়, তাহলে ঐ বিশাল ভূখন্ডের কোটি কোটি মুসলমানের
ভাগ্যে কি ঘটবে? তারা কোথায় যাবে?
এতদিন এমিলিয়ার ধারণা, ছিল, ইসরাইলীরা
আত্মরক্ষায় সচেষ্ট। কিন্তু আজ তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, ঘৃণ্য
সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা নিয়ে তার দেশ শক্তি বৃদ্ধি করছে। আর ফিলিস্তিন ও
আরব মুসলমানরাই যথাযথভাবে আত্মপ্রতিষ্ঠা আর আত্মরক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছে।
ওসেয়ান কিং জাহাজের অগ্নিকান্ড যদি তাদের সেই সংগ্রামের অংশ হয়, তাহলে
তাকে নিষ্ঠুর বলা যাবে কোন যুক্তিতে? মাহমুদকে নির্দোষ করতে পেরে গভীর
প্রশান্তিতে বলে গেল এমিলিয়ার মন।.............
অন্যান্য অধ্যায় পড়তে......
No comments:
Post a Comment